কিছু কিছু স্ফুলিঙ্গ তলোয়ারে লেগে চড়চড় শব্দে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। আর কিছু কিছু তলোয়ারে বাড়ি খেয়ে উপরে উঠে গেল। তারপর আবার পড়তে লাগল।
এবং পড়তে লাগল সালমি বেন কাজেমের মাথায়।
না-আ!! আর্তনাদ করে উঠল জাদুকর।
চমকে উঠল কিশোর।
কিছু স্ফুলিঙ্গ তার পাগড়িতে পড়ল। অমনি হিশহিশ শব্দ উঠল। কিশোর দেখল স্ফুলিঙ্গ তার গায়ের যেখানে পড়ে, সেখান থেকেই নীলচে পিঙ্গল ধোঁয়া পেঁচিয়ে উঠতে শুরু করেছে।
অজস্র ফুলিঙ্গ জাদুকরের জোব্বা ঢেকে ফেলল দেখতে দেখতে। এবং সেই সঙ্গে নীলচে পিঙ্গল ধোঁয়ার মেঘ জমল তাকে ঘিরে।
ধীরে ধীরে ঘন, গাঢ় হয়ে এল ধোঁয়া।
সালমি বেন ক্যাজম সরে যেতে চাইল। কিন্তু না-ছোড় ধোঁয়া তাকে কামড়ে ধরার মত ঘিরে থাকল চারপাশ থেকে। হাত-পা সমানে ছুঁড়েও সে ধোঁয়া সরাতে পারল না।
ঘন, ঢেউ খেলানো ধোঁয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে অসহায়ভাবে হাত-পা ছুঁড়ছে জাদুকর। ধোঁয়ার হাত থেকে কিছুতেই রেহাই পাচ্ছে না।
না-আ-আ!বোঝা যাচ্ছে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে তার করে হাত-পা ছুঁড়ছে পাগলের মত।
লাভ হচ্ছে না।
জিনা নিঃশব্দে কিশোরের পাশে এসে দাঁড়াল।
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ওরা দেখল, নীলচে পিঙ্গল ধোঁয়া পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে ফেলল জাদুকরকে। ক্রমশ ঘন হচ্ছে ধোঁয়ার প্রাচীর।
-না-না-আ! সমানে চেঁচিয়ে চলেছে সালমি বেন কাজেম। চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করছে। চেহারা বিকৃত। হাঁ হয়ে গেছে মুখ। মুখে ঢুকছে ধোঁয়া।
একটু পর আবছা হয়ে এল জাদুকরের কাঠামো।
তার জোব্বার জাদুকরী মেডেলগুলো ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর তার সাদা দাড়িও ঢেকে গেল নীলচে পিঙ্গল ধোঁয়ায়।
দুচোখ ঢেকে গেল।
এখন তার হাত-পা ছোঁড়া আর দেখতে পাচ্ছে না কিশোর জিনা।
পাগড়ির উপরের অংশটুকু শুধু দেখা যাচ্ছে।
না! না! না! ধোঁয়ার মেঘের ভিতর থেকে তার দুর্বল কণ্ঠের। আর্তনাদ ভেসে আসছে।
এ হতে পারে না। কিছুতেই না। আমার এই পরিণতি কিছুতেই হতে পারে না। শয়তান বিচ্ছুর দল! আমি সালমি বেন কাজেম, পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জাদুকর। আহ্-না-আ-আ! আমি তোমাদের ছাড়ব না। আমি…
জাদুকরের কণ্ঠস্বর আরও দুর্বল হয়ে এল।
এক সময় আর কথা শোনাই গেল না। ধোঁয়ার মেঘ সমানে ঘুরপাক খাচ্ছে।
বিচ্ছিরি একটা গন্ধ এসে ঝাঁপটা মারল দুই কিশোর-কিশোরীর নাকে। দম বন্ধ হয়ে এল। জিনা কেশে উঠল।
চারদিকে অসহ্য নীরবতা নেমে এসেছে হঠাৎ করেই।
কিশোর আর জিনা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
কান খাড়া। পরবর্তী ঘটনার অপেক্ষায় আছে।
কোত্থেকে কে জানে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে শীতল করে তুলল পরিবেশ। ধোঁয়ার ঘন মেঘ দ্রুত কেটে গেল।
ধোঁয়ার সঙ্গে মিলিয়ে গেছে সালমি বেন কাজেম।
নাকি নিজেই উধাও হয়ে গেছে জাদুর বলে?
না, আসলে তা হয়নি।
জাদুকর যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে কিছু একটা দেখল কিশোর। সামনে এগিয়ে গেল ওরা।
একটা কুৎসিত, পিঙ্গল শামুক দেখে ঘৃণায় মুখ কুঁচকে ফেলল। জিনা।
ওটা আমাদের আর ক্ষতি করতে পারবে না, বলতে বলতে শামুকটার পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর। ফোলা ফোলা লাল দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে শামুকটার শুড়ের শেষ মাথায়। পুরু হয়ে শ্যাওলা জমে আছে ওটার খোলে।
জিনা দুপা এগোল।
ওর উত্তেজিত শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে কিশোর। হাতের তলোয়ার দিয়ে শামুকটার গায়ে খোঁচা মারল ও। শামুকটার। শুড় কিছুক্ষণ শূন্যে এদিক-ওদিক করল। চোখ দুটো মনে হলো ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বীভৎস মাথাটা ঝকাল ওটা। তারপর টলতে টলতে পিছলে সরে যেতে লাগল। কিছুদূর গিয়ে স্থির হলো।
চিরতরে।
মেঝেতে অবশিষ্ট রইল কেবল সালমি বেন কাশেমের পোশাকের রঙের মত পিঙ্গল তরলের পিচ্ছিল একটা দলা।
১৮
কিশোর, তুমি… ঠিক আছ… বিড়বিড় করে বলল জিনা। ওর ফ্যাকাসে মুখে হাসি ফুটল। সত্যি তুমি সাঙ্ঘাতিক!
কিশোর হাসল। হেলমেট খুলে ফেলল। ওটার ওজন আর সহ্য করতে পারছে না।
সাঙ্ঘাতিক? মাথার উপর, তলোয়ার ঘোরাল কিশোর। তবে তোমার মত অতটা সাঙ্ঘাতিক নই, জিনা। ওই বর্মটা পরার আইডিয়া কী করে এল তোমার মাথায়?
আসলে তোমার সঙ্গে মজা করার জন্যে ওটার মধ্যে ঢুকেছিলাম, লাজুক মুখে স্বীকার করল জিনা। কিন্তু যখন হ্যাগার্ডের… মানে সালমি বেন কাজেমের কথা কানে এল, তখন নিজেই চমকে উঠলাম। জানতাম বাবা জরুরি একটা কাজে বাইরে গেছেন। মাকে ডাকব ভাবলাম, তারপর মনে হলো তাঁর সাহায্যের আশায় বসে না থেকে ভেতরে ঢুকে পড়া দরকার। ওইলোক তোমাকে বেড়াল বানিয়ে ফেলার মন্ত্র পড়া শুরু করতেই ঘাবড়ে গেলাম আমি। বাধ্য হয়ে ঠিক করলাম জাদুকরের মন্ত্র পড়া থামানোর ঝুঁকিটা নেব।
তোমার এত বুদ্ধি সত্যিই আমার জানা ছিল না, এর বেশি কিছু বলা সম্ভব হলো না কিশোরের পক্ষে। বলার মত অবস্থাও নেই।
হাই তুলে তলোয়ারটা একদিকে ছুঁড়ে মারল ও। এরপর একে একে খুলে ফেলল বর্মের বাকি অংশ। মেঝেতে ওগুলোর স্তূপ জমে গেল।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে কাঁধ ঝাঁকাল কিশোর। এমন ওজনদার বর্ম পরে আগের দিনের সৈন্যরা যে কীভাবে লড়াই করত, ভেবে পাই না।
নেজার ম্যাণ্ডারের বর্মের স্তূপের পাশে বসে পড়ল ও।
বর্মটাকে আবার দাঁড় করাতে খুব একটা কষ্ট হবে না পারকার আঙ্কেলের। এবার আর কোনও ভূত-টুতের ভয় নেই। ফেলে দেয়া তলোয়ারটা তুলে নিয়ে ওটা দিয়ে নেজারের একটা জুতোয় খোঁচা মারল ও। দূরে সরে গেল জিনিসটা। এবার একটা গ্লাভ ঠেলে সরাল একপাশে। তারপর তলোয়ার ফেলে দিল।