পরক্ষণে নিঃশ্বাস ছাড়ল।
পচা, অসহ্য দুর্গন্ধ বাতাস ধাক্কা মারল কিশোরের নাকে। গলা দিয়ে নাড়ি-ভুঁড়ি ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল। বর্মের ভিতরে বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য ওর ফুসফুস হাঁসফাস করতে লাগল।
কিন্তু কোথায় পাবে বিশুদ্ধ বাতাস?
কিশোর দেখল দানবটার প্রকাণ্ড দুই চোয়াল আবার আলগা হয়ে গেছে। লাফিয়ে পিছু হটল ও। ওটার মুখের দুর্গন্ধ অসহ্য লেগে উঠল। প্রাণীটার মুখ দিয়ে আগুনের লম্বা একটা শিখা বেরিয়ে আসতে দেখে আত্মা উড়ে গেল ওর। সেই শিখা ওর পায়ের কাছে এসে আছড়ে পড়ল। মনে হলো পা পুড়ে গেল বুঝি।
মুখ দিয়ে দুর্বোধ্য একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল কিশোরের। পায়ে পায়ে পিছু হটতে বাধ্য হলো ও।
ডাইনোসরটা আবার লম্বা দম নিল।
আরেক হলকা আগুনের মোকাবিলা করতে তৈরি হলো কিশোর।
জিনাকে একটা ফায়ার এক্সটিংগুইশার হাতে ছুটে আসতে দেখল। ও। দুর্ঘটনা এড়াবার জন্য পারকার আঙ্কেল ওগুলোর বেশ কয়েকটা এনে রেখেছেন জাদুঘরে।
জিনা ওর গা থেকে বর্ম খসিয়ে ফেলেছে। এখন দ্রুত চলাফেরা করতে পারছে।
ডাইনোসরের দিকে এক্সটিংগুইশার তাক করল জিনা। লিভার টেনে ধরল।
প্রথমে ফট! করে একটা আওয়াজ হলো। তারপর হুশশ শব্দে ফেনিল সাদা তরল ছড়িয়ে ছুটল উপর মুখো হয়ে। তীব্র বেগে ছুটে গিয়ে ডাইনোসরের গলায় পড়ল ধারাটা। কিশোরের গায়েও ছিটে এসে লাগল।
জিনার পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর।
মুখ তুলে ডাইনোসরটার দিকে তাকাতেই আঁকি খেল ও। ওটা আর ডাইনোসর নেই। সালমি বেন কাজেম হয়ে গেছে।
ফেনিল তরল তার দাড়ি বেয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। পাগড়ি আর জোব্বাতেও সাদা ফেনা লেগে আছে।
লোকটার হলদে চেহারায় উদ্বেগের ছাপ।
শয়তানের দল! আমার সাথে মশকরা! হুঙ্কার ছেড়ে হাতের লাঠিটা শূন্যে দোলাতে লাগল সে। সেই সঙ্গে বিড়বিড় করে কী সব মন্ত্র আওড়াতে লাগল।
ছড়িটা মাথার উপর ছুঁড়ে মারল সে।
পাক খেতে খেতে উপরে উঠে গেল ওটা। আবার ফিরে এল। ওটা যখন খপ করে ধরে ফেলল কাজেম, তখন আর ওটা ছড়ি নেই, তীক্ষ্ণধার একটা তলোয়ার হয়ে গেছে।
ওটার গা থেকে আলো ঠিকরে বের হলো।
হামলা করবে বলে তলোয়ারটা বাগিয়ে ধরল জাদুকর।
কিশোর, সাবধান! চিৎকার করে ওকে সতর্ক করল জিনা।
দরকার ছিল না অবশ্য। বাঁচার সহজাত প্রবৃত্তির বশে কিশোর আগেই তলোয়ার উঁচিয়ে ধরেছে।
জাদুকর ওর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
তলোয়ার চালাল সালমি বেন কাজেম। নিজের সোনালি তলোয়ার দিয়ে আঘাতটা ঠেকাল কিশোর। দুই তলোয়ারে সংঘর্ষ হলো বিকট শব্দে।
আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুটল।
কিশোরের হাত কেঁপে উঠল। মনে হলো কাঁধ থেকে হাত ছিঁড়ে যাবে।
বেন কাজেম কিশোরকে লক্ষ্য করে আবার তলোয়ার চালাল।
লাফিয়ে সরে গিয়ে আঘাতটা এড়াল কিশোর।
সালমিও সামান্য পিছিয়ে গেল।
ঘন ঘন দম নিচ্ছে সে। হাঁপিয়ে উঠেছে।
কিশোরের অবস্থা আরও খারাপ।
ক্রুদ্ধ চোখে পরস্পরকে দেখল দুজন। ঘেমে একাকার হয়েছে কিশোর। গাল বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঘাম চোখে পড়তেই চোখ জ্বলে উঠল ওর। বর্মের মধ্যে ওর বুকটা ধুকপুক করছে। যতটা না ভয়ে, তার চেয়ে বেশি উত্তেজনায়।
শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টার ফাঁকে সালমি বেন কাজেমের উপর দৃষ্টি স্থির করল কিশোর। লোকটা এখন কী করে বসে বলা যায় না।
জাদুকর তার তলোয়ার ওঠাল।
কিশোর তার ঠোঁট কাঁপতে দেখল। তাকে গোঁ-গোঁ করতে শুনল। গো-গোঁ করে মন্ত্র পড়ছে এখন!
জাদুকর তার তলোয়ার কিশোরের দিকে তাক করল।
কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। তারপর আচমকা জাদুকরের তলোয়ারের চোখা প্রান্ত থেকে ছরছর করে পিঙ্গল স্ফুলিঙ্গ বেরিয়ে এল। কাঁচের সিলিঙে আঘাত করল। ভেঙে ওদের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল কাঁচের টুকরো।
স্ফুলিঙ্গটার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকতেই হাত-পা অসাড় হয়ে এল কিশোরের। মাথা ঝিম ধরে গেল। ভারী হয়ে এল চোখের পাতা।
লক্ষণ খারাপ।
ওদিকে তাকিয়ো না, কিশোর, মনে মনে নিজেকে নির্দেশ দিল ও। খবরদার, ওদিকে তাকিয়ো না। চোখ সরিয়ে নাও।
কিন্তু কাজ হলো না। নিজের নির্দেশ নিজেই অমান্য করল।
জাদুকরের তলোয়ারের ফুলিঙ্গ রত্নের মত ঝকম করছে।
সম্মোহিতের মত একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকল কিশোর। চোখ ফেরাতে পারছে না।
এখনও সময় আছে! মরিয়া হয়ে নিজেকে বলল ও মনে মনে। চোখ ফিরিয়ে নাও। নইলে শেষ হয়ে যাবে তুমি। জাদুকর তোমাকে…
ঘন ঘন চোখের পলক পড়তে লাগল কিশোরের। চোখের পাতা অসম্ভব ভারী ঠেকছে। বুজে আসতে লাগল দুচোখ। প্রায় বুজে এল।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। মাথা আরও ভারী ঠেকল। এত ভারী যে খাড়া রাখতে সমস্যা হলো।
দুচোখ বুজে এল ওর। চিবুক বুকে ঠেকে গেল। দুই হাঁটু বেজায় দুর্বল ঠেকছে। পা জোড়া টলে উঠল। পড়ে পড়ে অবস্থা।
না, কিশোর, না! জিনা চিৎকার করে উঠল। কিশোরের মনে হলো ওর গলা কয়েক মাইল দূর থেকে ভেসে আসছে। চোখ খোলো, কিশোর! প্লিজ, চোখ খোলো!
জানে না কীভাবে, অবশেষে চোখ মেলে তাকাল কিশোর।
পিঙ্গল স্ফুলিঙ্গ ওর চারপাশে ঝরে পড়ছে। ওগুলো গায়ে পড়লে কী ঘটতে পারে, জানে না কিশোর। জানতে চায়ও না। এখন ওসব ভাবার সময় নেই।
শরীরে যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট আছে, তা-ই দিয়ে দুহাতে তলোয়ারটা আঁকড়ে ধরে তুলল কিশোর। কাধ সমান উঁচুতে তুলে তৈরি হলো। স্ফুলিঙ্গ ওর কাছে এলেই তলোয়ারের খোঁচায় দূরে সরিয়ে দিল।