দুবার বলা শেষ হয়েছে কী হয়নি, এমন সময় তীক্ষ্ণ একটা কণ্ঠ চেঁচিয়ে উঠল, থামো!
থতমত খেয়ে সামনে তাকাল সালমি বেন কাজেম।
একটু একটু করে বড় হয়ে উঠল দুচোখ।
কনজারভেটরির আরেক প্রান্তের ছায়ার ওদিক থেকে এসেছে। নির্দেশটা।
অপার্থিব শোনাল কণ্ঠটা।
কাঁটা দিল কিশোরের গা। বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করে উঠল। হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড়।
ছায়ার ভিতর থেকে একটা ছায়া-কাঠামো বেরিয়ে এল ধীরে ধীরে। যতই এগোতে থাকল, ততই স্পষ্ট হতে থাকল অস্পষ্ট কাঠামোটা।
ধাতব জুতো পরে আছে ওটা।
পরে আছে চওড়া ব্রেস্টপ্লেট।
মাথায় হেলমেট।
ওটার মুখাবরণের উপর দিকে দুটো ফাঁকা জায়গা। চোখের ফুটো।
বর্মধারী তার এক হাত তুলল।
কাজেমের উদ্দেশ্যে গগমে কণ্ঠে বলল, শয়তান জাদুকর, এবার মরার জন্য তৈরি হও।
১৬
নেজার ম্যাণ্ডার!
আবার ফিরে এসেছে!
আড়ষ্ট ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে বর্মধারী।
এক কদম।
দুই কদম।
তিন কদম।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বর্মটার দিকে তাকাল কিশোর। এবং বিষম খেল।
নেজার ম্যাণ্ডার নয় ও। মিস্টার পারকারের নকল বর্ম ওটা, জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু তা-ই বা কী করে সম্ভব?
এসব হচ্ছেটা কী? চিন্তায় পড়ে ভাবল কিশোর। নেজারের ভূত কি এখন এই বর্মের ভিতরে ভর করেছে?
বর্মধারী যত এগিয়ে আসছে, তত পিছাতে লাগল কিশোর। যদিও বুঝতে পারছে তার চাউনি ওর উপর নয়, জাদুকরের উপর স্থির।
কাজেমের দিকে তাকাল কিশোর। তারপর বর্মধারীর দিকে।
কার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত ওর? কোনজন বেশি খারাপ?
কিন্তু ভাবনা নিয়ে এগোবার সুযোগ পেল না কিশোর। জাদুকরের চোখ ঝিকিয়ে উঠল। কাঁধ ঝাঁকাল সে।
দুহাত বাড়াল দুদিকে।
বিড়বিড় করে মন্ত্র আওড়াতে শুরু করল।
আরও এগিয়ে এল বর্মধারী। চট করে জাদুকরের দিকে এক হাত বাড়াল সে। তার হাত জাদুকরের লাঠির ডগা ছুঁয়ে দিল।
সময় মত সরে যেতে পারল না কাজেম। তার ছড়ির নীল মার্বেলটা নড়ে উঠল। এদিক-ওদিক করতে লাগল।
তারপরই ওটা পড়ে গেল ছড়ির মাথা থেকে।
মরিয়া হয়ে দুহাত আগে বাড়াল জাদুকর। মার্বেলটা পড়ে যাচ্ছে। ওটা ধরতে চায় সে। কিন্তু পারল না। তার আঙুল ছুঁয়ে ফ্লোরে আছড়ে পড়ল খুদে জিনিসটা।
ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
কান ফাটানো আওয়াজ উঠল একটা। বজ্রপাতের শব্দকে হার মানায় সে আওয়াজ।
ঝিকিয়ে উঠল উজ্জ্বল, নীল আলো।
এতই উজ্জ্বল যে চোখ বুজতে বাধ্য হলো কিশোর।
এরপরই অদ্ভুত একটা য্যযু জাতীয় আওয়াজ কানে এল।
লকেটটা ভেঙেচুরে অগুনতি টুকরোয় পরিণত হয়েছে। অজস্র টুকরো হয়ে ছুটল এদিক-ওদিক।
কাঁচের টুকরোগুলোকে খুদে নক্ষত্রের মত লাগছে।
এক মুহূর্ত পরই ফ্লোর থেকে নীল ধোঁয়ার মেঘ উঠতে দেখা গেল।
উঠতেই থাকল।
লকেটটা যেখানে পড়ে ভেঙেছে, সেখান থেকে অনবরত ধোঁয়া উঠছে। মাটির নীচের কোনও ধোঁয়ার উৎসমুখ যেন খুলে গেছে।
গলগল করে বের হচ্ছে তো হচ্ছেই।
জীবনে অনেক আজব কাণ্ড দেখেছে কিশোর, কিন্তু এমন কাণ্ড দেখেনি।
নীল ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।
শীতের সময় ঘন কুয়াশা যেমন ভেসে বেড়ায়, কনজারভেটরির মধ্যেও তেমনি নীল ধোঁয়া ভেসে বেড়াচ্ছে। তবে এই ধোঁয়া অস্থির ও রহস্যময়।
কিশোরের পা ঢেকে ফেলল নীল ধোঁয়া। শরীরের যেখানেই ধোঁয়া লাগছে, সেখানেই ঠাণ্ডা লাগছে। মনে হলো হাড়ে গিয়ে ঠেকছে। ঠাণ্ডা।
এরপর জাদুকরকে ঘিরে ধরতে শুরু করল ধোঁয়া।
নীল ধোঁয়া তাকে ঘিরে উঠছে তো উঠছেই। থামাথামি নেই। পিঙ্গল জোব্বা পরা লোকটা ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।
না! না! আর্তনাদ করে উঠল সে। উন্মত্তের মত দুহাত নাড়তে লাগল উপর-নীচ, এদিক-ওদিক।
ধোঁয়া সরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
কিন্তু বেয়াড়া ধোঁয়ার মেঘ গিলে ফেলেছে তাকে।
মুখের সামনে থেকে ধোঁয়া সরানোর মরিয়া চেষ্টা করল জাদুকর। পারল না।
খেপার মত বুট দিয়ে ধোঁয়ায় লাথি হাঁকাল অনর্থক।
নীল ধোঁয়া তাতে বরং গাঢ় হলো আরও।
এবার হাল ছেড়ে দিল জাদুকর। অসহায়ের মত কপাল টিপে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।
পরক্ষণে ফ্লোর হাতড়াতে শুরু করল পাগলের মত।
কী খুঁজছে লোকটা?
কী?
কী আছে ওখানে, যার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে? ভাবতে লাগল কিশোর। গাঢ় ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে ফ্লোর দেখার চেষ্টা করল।
হ্যাঁ, দেখতে পেল জিনিসটা।
ছোট্ট সোনালি একটা তলোয়ার। ধোঁয়ার মধ্যেও ঝমক করছে।
বিস্ময়ে গুঙিয়ে উঠল কিশোর।
এতদিন ওটা নিশ্চয়ই লকেটটার মধ্যে লুকানো ছিল। জাদুকর ওটার দিকে হাত বাড়াল।
ডাইভ দিল কিশোর।
কেন যেন মনে হলো ওই ছোট্ট জিনিসটা এখন ওকে এই ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে।
হ্যাঁ, বরাবরের মত এবারও জিত হলো কিশোরের। এতদিন হারিয়ে এসেছে হ্যাগার্ডকে। এবার হারাল জাদুকর সালমি বেন কাজেমকে।
তলোয়ারটা ধরতেই ওর মনে হলো যেন হাতে বৈদ্যুতিক শক লেগেছে। বেদম এক ঝাঁকি খেল।
টান মেরে হাত পিছিয়ে নিল। তবে তলোয়ারটা ছাড়ল না। হাতের সবকটা আঙুল চিনচিন করে উঠল ব্যথায়।
পাত্তা দিল না কিশোর।
শক্ত হাতে ধরে রাখল জিনিসটা। ওর মুঠো থেকে স্ফুলিঙ্গ ছুটতে লাগল। মুঠো সামান্য আলগা করল।
ছোট্ট তলোয়ারটা বড় হতে শুরু করেছে। কিশোরের হাতে বড় হচ্ছে ওটা।
বড় হতেই থাকল।
লম্বা হচ্ছে। ফলা চওড়া, ভারী হচ্ছে।