ওগুলোর মধ্যে বড়সড় একটা নীল বৃত্ত দেখতে পেল কিশোর। ওটার মধ্যে নীল ধোঁয়ার মেঘ ঘুরপাক খাচ্ছে। ঠিক ওর লকেটের মত। মুখ নিচু করে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকল কিশোর। জুলজুল করছে জিনিসটা।
শোনো, কিশোর, হ্যাগার্ড, মানে সালমি বেন কাজেম বলে উঠল। সারা গায়ে শিরশিরে একটা অনুভূতি জাগল কিশোরের। যেন অজস্র ঘাসফড়িং হেঁটে বেড়াচ্ছে দেহে। তুমি ভেবেছ এসব তুমিই করেছ, তা-ই না? থেমে আবারও একচোট হেসে নিল সে।
জাদুর জ-ও জানা নেই তোমার, আছে? জাদুশক্তি আছে আমার। আসল কথা হলো আমি তোমাকে ব্যবহার করেছি, আমার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। দুশমনকে খতম করার জন্যে।
সালমি তার লম্বা, রুপোলি লাঠিটা তাক করল ধ্বংস হয়ে যাওয়া। বর্মটার দিকে। পিঙ্গল বুট দিয়ে পায়ের কাছে পড়ে থাকা হেলমেটে লাথি ঝেড়ে দিল। ঠুংঠাং শব্দে গড়িয়ে গেল ওটা এক কোনায়।
চাপা হাসল জাদুকর।
প্রতি আশি বছর পরপর নেজার আর আমাকে লড়াইয়ের জন্যে মুখোমুখি হতে হয়, বলতে শুরু করল সে। আমি তাকে হারাতে পারলে যথারীতি ঘুম দেয় সে পরবর্তী আশি বছরের জন্যে। এই আশি বছর সে অপেক্ষায় থাকে পরবর্তী লড়াইয়ের। আমাকে হারানোর অপেক্ষায় থাকে। কারণ আমাকে হারাতে পারলেই… থেমে শ্রাগ করল জাদুকর।
কিন্তু সেটা হবার নয়, আবার বলল সে। তীক্ষ্ণ চোখে কিশোরের দিকে তাকাল।
ঢোক গিলে অজান্তে এক পা পিছিয়ে গেল কিশোর।
নেজার ম্যাণ্ডারের একটা মন্তব্য মনে পড়ে গেল। সে বলেছিল, এর আগে যে জাদুকরের বিরুদ্ধে সে লড়েছে, ডাইনোসরের রূপ ধরেছিল সে, আগুনের দেয়াল হয়েছিল।
ঠিকই বলেছিল নেজার, কিশোরের মনের কথা বুঝতে পেরে বলে উঠল কাজেম। সে তোমাকে সালমি বেন কাজেম মনে করেছিল। ভেবেছিল তোমার মত ছোটখাট, দুর্বল এক ছেলের রূপ ধরেছি বুঝি। আমার পরিকল্পনা আসলে এরকম ছিল না। তবু এতেই কাজ হয়ে গেল। আমার মত এক জাদুকর কেন এইরকম আস্তাকুড়ে এসে উঠেছে, জানো?
জবাব দিল না কিশোর।
কনজারভেটরির চারদিকে তাকাল জাদুকর। চোখমুখ কুঁচকে উঠল।
কারণ আমার ক্ষমতার বলে জানতে পেরেছিলাম আজ হোক কাল হোক নেজার আসবেই এখানে। তোমার বান্ধবীর চাচা বর্মটা মণ্ট্যানা থেকে এখানে পাঠাবে। এক বুড়োর কাছ থেকে কিনে এখানে পাঠানোর অনেক আগে থেকেই জানতাম। অপেক্ষা করতে হলো আমাকে। কারণ তার সঙ্গে লড়াইয়ের নির্দিষ্ট সময় ঘনিয়ে এসেছিল।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে কিশোরের লকেটটার দিকে তাকাল কাজেম। ঠোঁট, চাটল জিভ দিয়ে। মুচকি হাসল।
গা শিরশির করে উঠল কিশোরের।
আমার আগেই তুমি ওই লকেট কফিন থেকে তুলে নিয়েছিলে, বলল সে। পরেও ফেলেছিলে সঙ্গে সঙ্গে। ওটাকে ধরা-ছোঁয়ার নির্দিষ্ট একটা নিয়ম আছে। তুমি আগে ছুঁয়ে ফেলায় আমি আর হাত বাড়াতে পারিনি ওটার দিকে। ছিনিয়ে নিতে পারিনি ওটা তোমার কাছ থেকে। পারার কথাও নয়। কারও নেই সে-ক্ষমতা। অন্তত যতক্ষণ না নেজার নতুন করে আশি বছরের জন্যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এখন…
সম্মোহিতের মত হয়ে গেছে কিশোর অনেকটা।
চুপচাপ জাদুকরের কথা শুনছে।
ক্রুর হাসি ফুটল জাদুকর কাজেমের ঠোঁটে।
মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা নেজারের ছিন্নভিন্ন বর্মটার দিকে তাকাল সে। জ্বলজ্বল করছে তার দুচোখ।
হাতের ছড়িটা কিশোরের দিকে তাক করল সে।
ওটার মাথা থেকে সরু একটা আলোর রেখা ছুটে এল কিশোরের দিকে।
ওর বুকে এসে লাগল।
লকেটটা ঝকমক করে উঠল, যেন কাজেমের জাদুর জবাব দিল।
বুক থেকে শূন্যে উঠে পড়ল ওটা, এগিয়ে গেল জাদুকরের দিকে। কিশোরকেও টেনে নিয়ে চলল ওটা।
জাদুর শক্তির কাছে হার মানল কিশোরের শক্তি।
আমার জিনিস তোমার কাছে থাকবে কেন? ছড়ির মাথা দিয়ে লকেটটা স্পর্শ করল জাদুকর। ছিঁড়ে গেল চেইন।
ছড়িটা দোলাতে লাগল জাদুকর। কিশোরকে অবাক করে দিয়ে। ওটার মাথায় সেঁটে থাকল লকেটটা।
আমার জিনিস এখন আমার কাছে, বলল সে।
নেজার আর কোনওদিন আমার সঙ্গে সুবিধে করতে পারবে না। জাদুর এই লকেট আমাকে আরও ক্ষমতাধর করে তুলবে।
মার্বেলটার দিকে তাকাল সে।
শয়তানী হাসিতে চেহারা ভরে উঠল।
কিশোরের দিকে মন দিল জাদুকর। সুন্দর চেহারার খুঁত কী। জানো? ব্রণ। আমার চলার পথে তুমিও এখন তা-ই। বিচ্ছিরি একটা খুঁত, একটা-ঝামেলা। তোমাকে শেষ করে দিতে হবে। গোপন অনেক কথা বলে ফেলেছি তোমাকে। আমি চাই না আর কেউ তা। জানুক। হুম! এখন আমার কী করা উচিত? শেষ কথাটা যেন নিজেকেই বলল সে।
ঠোঁট চাটল সালমি বেন কাজেম।
ভাবছে।
ভাবছে কীভাবে কিশোরকে খতম করা যায়।
ঢোক গিলল কিশোর।
অত্যন্ত সন্তর্পণে পিছিয়ে গেল এক পা। উদ্দেশ্য–খিঁচে দৌড় দেবে, যা থাকে কপালে।
ওসব চিন্তা বাদ দাও, গর্জে উঠল লোকটা। তার ভয়ঙ্কর চাউনি কিশোরকে জমিয়ে দিল। হ্যাঁ, পেয়েছি! তোমাকে নিকেশ করার কায়দা পেয়ে গেছি আমি। তোমাকে আমি একটা বিড়াল বানিয়ে ফেলব। তবে আগে থেকেই সাবধান করে দিচ্ছি–ভুলেও কুকুরের ধারে-কাছে যেয়ো না যেন। হাঃ হাঃ হাঃ।
শ্বাস-প্রশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল কিশোরের।
টের পেল হাতদুটো কাঁপছে। ওর কাঁপুনি টের পেয়ে ঠোঁট মুড়ে হাসল জাদুকর।
কিশোরের মাথার উপর হাত তুলে নাড়তে নাড়তে বলল, একদম নড়াচড়া করবে না। ভরা পূর্ণিমায় আমি, জাদুকর সালমি বেন কাজেম চাই, এই ছেলেটা বিড়াল হয়ে যাক… মন্ত্র পড়ার ভঙ্গিতে কথাটা বলে চলল সে।