ছিন্নভিন্ন ধাতুর একটা স্কুপে পরিণত হয়েছে ভুতুড়ে বর্মটা।
পটার ভিতর থেকে লাল ধোঁয়ার ভুতুড়ে মেঘ উঠছে পেঁচিয়ে পেচিয়ে।
নাক বন্ধ করে এক পা সামনে বাড়ল কিশোর। মৃদু একটা আওয়াজ কানে এল। সাইকেলের টায়ার পাংচার হলে এমন আওয়াজ হয়।
তীক্ষ্ণ চোখে স্তূপটার দিকে তাকাল কিশোর।
চলে গেছে নেজার ম্যাণ্ডার। চিরতরে চলে গেছে।
ও শেষ! ক্লান্ত স্বরে বলল, কিশোর। হেরে ভূত হয়ে গেছে! জীবনে কখনও এত খুশি হয়েছে কি না সন্দেহ। আসলেই যদি আমি জাদুকর হতাম! ভাবল ও।
এমন সময় একটা কণ্ঠ কানে এল ওর। অদ্ভুত, রক্ত পানি করা। স্বর।
দমকা বাতাসে মোমবাতি যেমন দপ্ করে নিভে যায়, তেমনি নিভে গেল কিশোরের আনন্দ।
চুপ করো বোকার হদ্দ! তুমি কিছুই করোনি। যা করার আমিই করেছি সব। সব আমি করেছি।
জমে গেল কিশোর।
সেই জাদুকরের কণ্ঠ?
কনজারভেটরির মধ্যে গমগমে প্রতিধ্বনি উঠল।
ওর চারপাশের কাঁচের দেয়াল কেঁপে উঠল। পায়ের নীচের ফ্লোর পর্যন্ত কেঁপে উঠল থরথর করে।
হঠাৎ হিমশীতল হাওয়ায় ভরে গেল গোটা কনজারভেটরি। কাপ ধরে গেল কিশোরের সারা দেহে।
ভয়ঙ্কর গলাটার উৎসের খোঁজে ঘুরে দাঁড়াল ও।
বোকারাম! তুমি কী মনে করেছ তোমার জাদুশক্তি আছে? হাহ্ হাহ হাহ!
আওয়াজটা কি হ্যাগার্ডের গলা দিয়ে বেরোচ্ছে?
হ্যাগার্ডের?
তা হয় কী করে?
আবারও হেসে উঠল হ্যাগার্ড। শিরদাঁড়ায় শীতল প্রবাহ টের পেল কিশোর। এমন পৈশাচিক হাসি মানুষ হাসতে পারে?
কী ভয়ঙ্কর সেই হাসি! কলজের পানি জমিয়ে দেয় একেবারে।
লোকটার দাঁতগুলো তীক্ষ্ণ আর ছুঁচাল দেখাল। মুখের চামড়া টাটান হয়ে আছে, ঠিক যেন একটা রক্ত-মাংসহীন চামড়ামোড়া খুলি।
কী করবে ভেবে পেল না কিশোর।
মিস্টার হ্যাগার্ড? লোকটার দিকে চেয়ে থাকল ও।
হ্যাগার্ড সোজা হয়ে দাঁড়াল। কিশোরের মনে হলো ওর চারপাশের বাতাসে ঝড় উঠেছে। লোকটা ওর একটা হাত ধরল। মানুষটার হাত এত ঠাণ্ডা, চটচটে কেন? ঘামে গোসল হয়ে গেছে?
মিস্টার হ্যাগার্ড আপনিই কী… থেমে গেল কিশোর।
আমি হ্যাগার্ড নই, গমগম স্বরে বলল সে। আমি সালমি, সালমি বেন কাজেম–সর্বকালের সেরা জাদুকর। এবার তুমি মরার জন্য তৈরি হও!
ধীরে ধীরে দুহাত তুলল হ্যাগার্ড–না, সালমি বেন কাজেম। আঙুলে অনেকগুলো সোনালি আংটি, না আংটি কোথায়?
সাপ ওগুলো! সাপগুলোর জ্বলজ্বলে, লাল চোখগুলো বড় বেশি জ্বলজ্বল করছে।
কিশোরের দিকে হাত বাড়াল জাদুকর। আঙুল থেকে ঝুলছে সাপ। এদিক-ওদিক পিছলে যাচ্ছে, ঘুরপাক খাচ্ছে। বিস্ময়ের ঘোর সামলে উঠতে পারছে না কিশোর।
একটু পর বড় হতে শুরু করল সাপগুলো।
হচ্ছে তো হচ্ছেই!
হিশহিশ করতে করতে এগুলো তার কবজি পেঁচিয়ে সামনে এগোতে লাগল। ওগুলোর কুৎসিত জিভ লক্ করছে কিশোরকে লক্ষ্য করে।
একটা সাপ ছোবল মারার ভঙ্গিতে ঝট করে মাথা বাড়িয়ে দিল। ওর দিকে।
সময়মত সরে গেল কিশোর। ওটার হাঁ দেখে পিলে চমকে উঠল। তীক্ষ্ণধার দাঁত দেখা গেল ওটার।
হাত ঝাড়া মারল জাদুকর। সঙ্গে সঙ্গে কিশোরের চোখের সামনে যেন ভোজবাজির খেলা ঘটে গেল।
হিশহিশ করতে থাকা সোনালি সাপগুলো মুহূর্তে বজ্রে পরিণত হলো। আকাশের বজ্ৰ চমকে ওঠে মুহূর্তের জন্য, কিন্তু কাজেমের হাতের বজ্র লকলক করছে টিউব লাইটের মত।
দূরত্ব সামান্য বলে তুকে বজ্রের তাপের আঁচ পেল কিশোর। হঠাৎ একটা বজ্র ওর দিকে তেড়ে এল। ঝট করে মাথা নোয়াল ও।
দেরি হয়ে গেছে।
চুল পোড়ার বিচ্ছিরি গন্ধ এল নাকে।
ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারল না।
মিস্টার হ্যাগার্ড!
লোকটার সঙ্গে ওর রীতিমত বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। আর সে কি না ওকে ধোকা দিয়ে এসেছে?
অকল্পনীয়।
চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। বোকার মত তাকিয়ে আছে। লোকটার দিকে। কী করবে ভাবতে চাইল।
লোকটার দেহের গড়ন পাল্টে যাচ্ছে দেখে ঝাঁকি খেল কিশোর। এত বিস্ময়ের ধাক্কা সামলানো কঠিন।
লোকটার চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠল। তবে নেজার ম্যাণ্ডারের চোখের মত নয়।
কেমন শীতল এবং কঠিন।
ফয়েল পেপারের মোড়কের মত চকচক করছে লোকটার চামড়া। দেখতে দেখতে গায়ের রং পাল্টে যেতে থাকল। শুধু রং নয়, চেহারাও পাল্টাতে লাগল লোকটার। দুগালে কোত্থেকে যেন ঘন। চাপদাড়ি এসে জুটল। ধবধবে সাদা চাপদাড়ি।
মাথার উপর এক হাত তুলে ঘোরাল সে। অমনি কোত্থেকে একটা লম্বা রুপোলি ছড়ি চলে এল তার হাতে।
ছড়িটা মাথার উপর দ্রুত চক্রাকারে ঘোরাতে লাগল সে। বাতাসে শশ শব্দ তুলল ওটা। সবেগে ঘুরছে।
একবার… দুবার… তিনবার…
গতি আরও বাড়ছে। আবছা দেখাচ্ছে এখন ছড়িটাকে। মনে হচ্ছে মাথার উপর অস্পষ্ট একটা চাকতি ঘুরছে।
চোখের পলক পড়ল কিশোরের।
হাত থেমে গেল জাদুকরের।
কিশোরের মুখোমুখি হলো সে। লম্বা, পিঙ্গল একটা জোব্বা তার পরনে। পায়ে পিঙ্গল বুট। মাথায় ঝলমলে পিঙ্গল একটা পাগড়ি।
সালমি বেন কাজেমের জোব্বা আর পাগড়িতে সেঁটে থাকা অজস্র মেডেল ঝকমক করছে-রুপোলি চাঁদ, সোনালি তারা, আরও কত কী!
কোনওটা ছোট, কোনওটা বড়।
কোনওটা ঝকমক করছে, কোনওটা ম্লান।
এমন মেডেল ঠাসা পোশাক জীবনে দেখেনি কিশোর। ডেভিড কপারফিল্ড, আমাদের জুয়েল আইচ–ওঁরাও তো জাদুকর। কিন্তু এমন বিদঘুঁটে পোশাক তাদের পরতে দেখা যায় না! অবশ্য পরবেনই বা কেন, ওঁরা তো আর শয়তান জাদুকর নন।