সন্তুষ্ট হলেন মিস্টার পারকার। এই জাদুঘর তৈরি করবার পর থেকে মাঝে মাঝে হাসছেন।
কপাল কুঁচকে কিশোরের দিকে তাকাল জিনা। জাদুঘরের প্রতি কোনও আগ্রহই নেই ওর। এই বিদঘুঁটে, ভয়ঙ্কর সব কারবার ওর পছন্দ নয়। তাই এ নিয়ে বাবার তারিফ শুনতেও ভাল লাগছে না। কিশোর জাদুঘরের প্রশংসা করলেই খেপছে।
জাদুঘরটা সত্যিই দারুণ হয়েছে, আড়চোখে জিনার দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর। অনেক মেয়ে তো হার্টফেলই করবে। আসলেই ভয়ঙ্কর সমস্ত কাণ্ড আছে এখানে, আঙ্কেল।
হবে না? বিড়বিড় করে বলল জিনা। কলজের পানি শুকানো। রাজ্যের জিনিস এনে ঠেসে রাখলে ভয়ঙ্কর হবে না কেন? আমার তো মনে হয় টিকিট কেটে একবার যে আসবে, সে তার চোদ্দগুষ্টির কাউকে আর এখানে আসতে দেবে না। কাজ নেই, টাকা খরচ করে মানুষ আসবে ভয় পেতে, হুহ!
শুনে ফেলল কিশোর। কিছু বলতে যাবে, কিন্তু তার আগেই জিনা বলে উঠল, বাবা, এখনও সময় আছে, বন্ধ করো এসব। ড্রইংরুমে মমি, ডাইনিংরুমে কফিন, কিচেনে গুলতি-তলোয়ার; এসব ভাল ঠেকছে না আমার।
আমার কিন্তু ভাল লাগছে, মন থেকে বলল কিশোর।
জবাব দিল না জিনা। চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল।
আগে ওগুলো ড্রইং, ডাইনিংরুম, আর কিচেনে থাকলেও এখন। পুরো নীচতলায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
গোটা বাড়ি জাদুঘর নয়, জাদুঘর শুধু নীচতলাটা।
আঙ্কেল-আন্টি-জিনা উপর তলায় থাকে। আর আছে কয়েকটা গেস্টরুম। নীচের তলার চেয়ে দোতালাটাকে সাধারণ মনে হয়। কিশোরের। উপর তলায় কোনও ঝামেলা নেই। জাদুঘর চালু হলে। যখন-তখন মানুষ উপরে উঠে আসবে না।
মেয়ে ও কিশোরের উদ্দেশে বললেন মিস্টার পারকার, আর দুই সপ্তা পর ক্রিসমাস। গোবেল বিচে আজকাল এমনিতেই লোকজনের আনাগোনা বেশি, ক্রিসমাসের সময় আরও বাড়বে। এই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে হবে। রাতারাতি আমার ভৌতিক জাদুঘরের নাম ছড়িয়ে পড়বে। কালো ফ্রেমের চশমার পিছনে মিস্টার পারকারের চোখ জোড়া গম্ভীর হয়ে উঠতে দেখল কিশোর।
গোবেল বিচে ভৌতিক জাদুঘর এই একটাই। এর দর্শনার্থীরা দেখতে পাবে ভৌতিক কাজ কারবার। এখানকার প্রায় প্রতিটি দর্শনীয় জিনিসই ঐতিহাসিক এবং বিখ্যাত।
মোম-হলে ওত পেতে আছে মোমের তৈরি ডামি।
পিছনের পোর্চে ঝুলছে নির্যাতন করার ভয়ঙ্কর সব প্রাচীন যন্ত্রপাতি।
সামনের হলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে মধ্যযুগীয় ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র।
দর্শনীয় জায়গা বটে, ভাবল কিশোর।
দেখবেন লাইন দিয়ে দর্শক আসবে, বলল হ্যাগার্ড। মিস্টার পারকার সিনিয়র যা পাঠাবেন বলেছেন, সেটা এলে তো কথাই নেই, জাদুঘরের আকর্ষণ আরও বেড়ে যাবে।
মিস্টার পারকার মাথা দোলালেন। কাল ফোন করেছিল আমার ভাই। বলেছে ওটা ট্রান্সপোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছে। শীঘি এসে পড়বে। একটা প্রাচীন বর্ম আসছে ভাবতেই… কথা শেষ না করে থেমে গেলেন।
আঙ্কেলের চাচাত ভাই ওটা পাঠিয়েছেন।
আসলে কিশোরেরও তর সইছে না। আগেকার আমলের বর্মপরা সৈন্যদের আলাদা একটা আকর্ষণ আছে। মাত্র কদিনই কেয়ারটেকার হ্যাগার্ডের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব সৃষ্টির এটাও একটা কারণ। সে বর্মধারী সৈন্য সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। একবার বলা শুরু করলে আর থামতে পারে না।
ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান রাখে লোকটা।
হ্যাগার্ডের বয়স আন্দাজ করা যায় না। তবে দেখে মনে হয়। মিস্টার পারকারের চেয়ে বেশি। ছিপছিপে লম্বা দেহ। সাদা, বাবরি চুল কাঁধ ছুঁয়েছে। ঠোঁটের উপর চওড়া কাঁচাপাকা গোঁফ। লোকটা যখন নিজের প্রিয় বিষয় নিয়ে বলে, তখন তার চোখজোড়া চকচক করতে থাকে। মমি বানানোর কায়দা, গিলোটিনে গলা কাটার নিয়ম-ইত্যাদি বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান। কখনও কখনও এসব বিষয়ে তাকে বিশেষজ্ঞ মনে হয় কিশোরের।
অতীতের রাজ-রাজড়াদের আমলের বর্মধারী সৈন্য, তলোয়ার, প্রাসাদ, ড্রাগন এসব বিষয়েও যথেষ্ট জ্ঞান লোকটার।
বর্মধারী সৈন্যদের নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে, বিশেষ করে মধ্যযুগের ইউরোপীয় নাইটদের সম্বন্ধে। তাদের ব্যবহৃত সব ধরনের অস্ত্রের নাম জেনেছে কিশোর লোকটার কাছ থেকেই। নাইটদের যাবতীয় রীতিনীতির ব্যাপারেও বলেছে ওকে। এই রীতিনীতিটাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করত। কড়া ট্রেইনিং শেষে লড়াইয়ের কায়দা শিখত। হয়ে উঠত সাহসী বীর।
হ্যাগার্ড ধীর পায়ে কিশোরের পাশে এসে দাঁড়াল। সিনিয়র পারকার চিঠিতে বিশেষ একটা কথা লিখেছেন, ঠোঁটের কোণে হাসি তার। মনে আছে তোমাদের?
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। লিখেছেন, তোমাদের জন্যেও বিশেষ একটা উপহার পাঠিয়ে দিলাম।
জিনার চেহারা কালো হয়ে উঠল। সিনিয়র চাচা ওকে আলাদাভাবে কোনও উপহার পাঠাচ্ছেন না বলে মেজাজ খারাপ ওর। চেহারা কুঁচকে রেখেছে।
গত পরশু কিশোর ওর সঙ্গে অদ্ভুত এক বাজি ধরেছিল। দুজনকে সামনা-সামনি বসে পুরো একটা করে বাতাবি লেবু খেতে হবে, লবণ ছাড়া। খাওয়ার সময় বিরতি দেয়া যাবে না। জিনা অর্ধেকটা খেয়ে চেহারার যে অবস্থা করেছিল, এখনও ঠিক সেরকম দেখাচ্ছে।
শেষে বাজিতে অবশ্য ও-ই জিতেছিল। ওকে দুদুটো আইসক্রীম খাওয়াতে হয়েছে কিশোরকে।
সিনিয়র চাচা চিঠিতে আরেকটা কথাও লিখেছেন, কিশোর বলল। যে বর্মটা উনি পাঠাচ্ছেন, সেটা নাকি ভুতুড়ে।
ন্যাকড়া দিয়ে গালের রক্ত মুছতে মুছতে বললেন মিস্টার পারকার, ওটা যদি সত্যি সত্যি ভুতুড়ে হতো…