ডানে সরে ছুটতে লাগল কিশোর। ঘোড়সওয়ারও ডানে সরে গেছে বলে মনে হলো।
পরক্ষণে বাঁয়ে সরল ও। কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে তাকাল।
ওর পিছনেই রয়েছে হ্যাগার্ড। তার পিছনে নেজার।
তার মুখাবরণের দিকে তাকাতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল কিশোরের। বর্শাটা উঁচু করে ধরে আছে সে। ওটার চোখা মাথা দেখে আত্মা উড়ে গেল, কারণ বর্শাটা ওর দিকেই তাক করা।
সামনের দরজাটা মনে হলো বহু মাইল দূরে।
অমোঘ নিয়তির মত পিছন পিছন তেড়ে আসছে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত।
জানপ্রাণ বাজি রেখে ছুটছে কিশোর। লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। পা। অবশ হয়ে আসছে। তবু ছুটছে ও।
এখনও মনে হচ্ছে দরজাটা কয়েক মাইল দূরে। সারাজীবন ছুটেও ওটার নাগাল পাবে বলে ভরসা হলো না। কিশোরের।
আর হয়তো এক মুহূর্ত। তারপরই বর্শাটা ওর পিঠে গেঁথে দেবে শয়তানটা। ভাবতেই গায়ের সব রোম দাঁড়িয়ে গেল ওর।
ঠিক সে-সময় আরেকটা অদ্ভুত আওয়াজ শোনা গেল। জিভ আর টাকরা এক করে জোরে বাতাস ছাড়ার মত আওয়াজ।
ভয়ে চোখ বুজে ফেলল কিশোর। বুঝতে পারছে নেজারের বর্শা উড়ে আসার আওয়াজ ওটা। এখনই এফেঁড়-ওফোঁড় করে দেবে ওকে।
কিন্তু কিছুই ঘটল না।
থেমে পড়ল কিশোর। হ্যাগার্ডও। নিজের অজান্তে কেয়ারটেকারের বাহু খামচে ধরেছে কিশোর।
দেয়ালে ঝোলানো পারকার আঙ্কেলের সবগুলো বর্শা একযোগে উড়ে যাচ্ছে ওদের মাথার উপর দিয়ে। ওগুলোর লক্ষ্য। নেজার।
কয়েকটা ঠিক তার সামনের ফ্লোরে পড়ল। মাটিতে ডেবে গিয়ে এদিক-ওদিক কাঁপতে লাগল। কতগুলো বিধল পিছনের ফ্লোরে। সাত-আটটা ডানে আর বাকিগুলো বায়ে।
ঘেরাও হয়ে গেল নেজার।
অকল্পনীয় দৃশ্য!
অদৃশ্য কোনও হাত যেন বর্শার বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। তাকে। ঘোড়াটা আচমকা কান ফাটানো ডাক ছাড়ল, খুর দিয়ে সশব্দে মাটি ঠুকছে।
ক্রুদ্ধ গর্জন ছাড়ল নেজার। চোখের দুই গর্তের ভিতরদিকে লাল আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে।
হ্যাগার্ডের হাত ছেড়ে দিল কিশোর। উত্তেজনায় বুক ধুপধাপ করছে। সাহস করে সামনে এগোল। বর্শাগুলো পরখ করে দেখবে। কাণ্ডটা কীভাবে ঘটল ভেবে পেল না ও।
কী মনে করে মুখ নিচু করল কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে গলায় ঝোলানো লকেটের উপর চোখ পড়ল। ভিতরের ধোঁয়া আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে।
ঘুরপাক খাচ্ছে।
উঠছে-নামছে।
নীল আলো ঝিকমিক্ করছে ভিতরে।
নেজারের ভুতুড়ে চোখের চেয়েও উজ্জ্বল আলো।
এইবার আসল ঘটনা বুঝতে পারল ও। ঘটনা আসলে এই লকেটই ঘটাচ্ছে।
আরও একবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছে ওকে।
সামান্য একটা গুলতির পাথর কখনও স্টিলের অতবড় বর্মকে ঘায়েল করতে পারত না। গতকাল রাতে নেজারকে আসলে পাথর দিয়ে ধরাশায়ী করেনি কিশোর, এই লকেটই ওকে বাঁচিয়েছে প্রেতাত্মার হাত থেকে। আজও এটা আরেকবার বাঁচাল ওকে।
এটাই নিজের অলৌকিক শক্তির জোরে বর্শাগুলোর সাহায্যে নেজারকে ঠেকিয়েছে। লকেটটার যে অলৌকিক ক্ষমতা আছে, সে ব্যাপারে কিশোরের আর কোনও সন্দেহ রইল না।
মিস্টার হ্যাগার্ড, ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন? লোকটার দিকে তাকাল ও। চাঁদের আলোয় লকেট উঁচিয়ে ধরল। এই লকেট! এটাই এতসব করল জাদুর বলে!
লকেটটা শক্ত মুঠোয় ধরে বর্মটার কাছে এসে দাঁড়াল ও। হ্যাগার্ড ওর পিছনে দাঁড়িয়ে।
কেউ কোনও কথা বলতে পারল না।
ঘটনার আকস্মিকতায় ভাষা হারিয়ে ফেলেছে দুজনই।
ওদিকে দেয়ালে ঝোলানো তলোয়ারগুলো ঠুং-ঠাং শব্দে পরস্পর ঠোকর খাচ্ছে। কুঠারগুলো এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করছে শূন্যে, যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে ওগুলো।
অবিশ্বাস্য!
অকল্পনীয়!
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো কিশোরের।
কী মনে করে লকেটটা উঁচিয়ে ধরে নাড়তে লাগল গোয়েন্দা প্রধান।
অমনি ভয়ে নিচু হলো বর্মধারী। আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে একটা ধাতব হাত দিয়ে মুখ আড়াল করল।
তার মুখাবরণের উজ্জ্বল আলো হঠাৎ দপ্ করে নিভে গেল।
শুনতে পাচ্ছ? বর্মটার দিকে তাকিয়ে জোরে বলল কিশোর, এরপর আবার বাড়াবাড়ি করলে ফল ভাল হবে না।
সোজা হয়ে দাঁড়াল ও। বর্মের দিকে লকেটটা বাড়িয়ে ধরে রেখেছে এখনও। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা তলোয়ার একযোগে ছুটে এসে আঘাত করল বর্মটাকে।
বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে দুহাত চালাল নেজার। কিন্তু তলোয়ারগুলো ঠিকই আঘাত হেনে চলল। ব্যর্থ হলো না একটাও।
লকেট আরও উঁচু করে ধরল কিশোর। কাঁচের গোলকটার উপর চাঁদের আলো পড়ল। ঝলমল করে উঠল ওটা।
হঠাৎ করে ওটার ভিতর থেকে গাঢ় নীল আলোর রশ্মি বেরিয়ে নেজারের দিকে ছুটে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে গেল বর্মটা।
ঝকমক করে উঠল ওটা।
খটমট শব্দ উঠল কয়েক মুহূর্ত ধরে।
এবং তারপরই বিস্ফোরণ হলো!
বুম্ম্!
১৫
প্রচণ্ড শব্দের সঙ্গে হেলমেট তীরবেগে সিলিঙের দিকে ছুটে গেল।
গনগনে আগুন বেরিয়ে এল বর্মের ভিতর থেকে। পরক্ষণে গোটা বর্মটাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
নেজারের ব্রেস্ট প্লেটটা আছড়ে পড়ল মেঝেতে। হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল ঢাল। তার পরপরই জোড়া থেকে খসে পড়ল দুই হাত।
দুপা টলমল করে উঠল। এবং পরমুহূর্তে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মেঝেতে আছড়ে পড়ল।
ওদের বিস্ফারিত চোখের সামনে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল বর্মটা। অনেকটা টায়ার পোড়ার মত বিচ্ছিরি একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে।
নাক, বুকের ভিতরটা জ্বালা করে উঠল কিশোরের।