জাদুঘরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে গেল ওর। নামি দামি অনেক লোককে দাওয়াত করেছেন পারকার আঙ্কেল। লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে কয়েকজন রিপোর্টারও আসবে।
সবাই এখানে ভুতুড়ে কিছু দেখতে চাইবে সেটাই স্বাভাবিক। নিজের চোখে ভূত বা ওই জাতীয় কিছু দেখতে চাইবে।
নইলে ভুতুড়ে জাদুঘরের সার্থকতা কোথায়?
নতুন আরেক চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল কিশোরের মাথায়। ও যদি সত্যিই প্রেতাত্মাটাকে চিরতরে দূর করে দিয়ে থাকে, তা হলে আমন্ত্রিত অতিথিরা ভুতুড়ে কিছু দেখা থেকে বঞ্চিত হবে। জাদুঘরের বদনাম হয়ে যাবে।
হোক।
তবু জেনেশুনে কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে দিতে পারে না ও।
আপাতত বর্মটার ওপর নজর রাখা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই, বলল কেয়ারটেকার।
কিশোর বুঝল, ভুল বলেনি মানুষটা।
আরও কিছুক্ষণ টুন্টা কাজ করে কিশোরসহ কনজারভেটরি থেকে বেরিয়ে এল হ্যাগার্ড।
.
সে-রাতের কথা।
ঘম আসছে না কিশোরের।
বালিশে হেলান দিয়ে নীল লকেটের দিকে চেয়ে আছে। মন খারাপ।
মন খারাপের কারণ–নেজার ম্যাণ্ডার ফিরে আসতে পারে। মারাত্মক বিপদে পড়তে পারে বাড়ির যে-কেউ। পারকার আঙ্কেলের সাধের জাদুঘর লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে।
আরেকটা কথা ভেবেও খারাপ লাগছে ওর। নেজার ফিরে না। এলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান জমবে না।
এই ভাবনাটা দুর্বল করে তুলল ওকে।
খোদা, ফিরিয়ে আনা এই যোদ্ধার আত্মাকে, মনে মনে বলতে বাধ্য হলো কিশোর।
ভাবনার সাগরে এতই তলিয়ে গিয়েছিল কিশোর যে প্রথমে আওয়াজটা ঠিকমত শুনতে পেল না।
থপ থপ!
উঠে বসে কান পাতল ও।
থপ থপ!
জিনা! বিড়বিড় করল ও। আবার ভয় দেখাতে চেষ্টা করছে। বিছানা ছাড়ল ও। আমাকে বোকা পেয়েছে নাকি যে বারবার একই
কায়দায় ভয় দেখাবে?
ধীরে ধীরে নীচতলায় নেমে এল ও।
আওয়াজটা আরও জোরাল হলো। এগিয়ে চলল কিশোর শব্দ। লক্ষ্য করে। মনে হয় কিচেনের পিছন থেকে আসছে শব্দটা।
কিচেন? আবার কিচেনে গেছে ও? স্রেফ অবজ্ঞার সাথে মাথা ঝকাল কিশোর। মেয়েটার বুদ্ধি কমে গেল নাকি!
আলো জ্বালার ঝামেলায় না গিয়ে জাদুঘরের ভিতর দিকে এগোল ও। ওখান থেকে বেরিয়ে পা রাখল কিচেনে।
থপ থপ!
আওয়াজটা এবার স্পষ্ট শোনা গেল। কিন্তু জিনাকে দেখা গেল না। কিচেনে ওর টিকির চিহ্ন নেই।
কয়েক মুহূর্ত পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল কিশোর। ভয় একটু একটু করে চেপে ধরছে ওকে।
হঠাৎ কেউ বা কিছু একটা খপ করে ওর বাহু চেপে ধরল। ধড়াস করে লাফিয়ে উঠল কলজে।
সরি, কিশোর।
হ্যাগার্ড।
লোকটাকে দেখতে পেয়ে বড় করে শ্বাস ফেলল ও।
কিন্তু শব্দটা থামেনি।
এখনও চলছে।
অর্থাৎ হ্যাগার্ডেরও নয় কাজটা, জিনার তো নয়ই।
তা হলে?
ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে কিশোরকে চুপ থাকার ইশারা করল কেয়ারটেকার। আমি আসলে তোমাকে ভয় দেখাতে চাইনি, ফিসফিস করে বলল। মমিঘরে কাজ করছিলাম, হঠাৎ আওয়াজটা কানে এল। তোমার কী মনে হয়, কিশোর, ওটা কীসের আওয়াজ?
মনে হয় জিনার কাজ, বিড়বিড় করে বলল কিশোর। কাল রাতে সিলিঙে ঝাটার গোড়া দিয়ে শব্দ তুলে আমাকে ভয় দেখিয়েছে ও। আজও বোধহয় তা-ই করছে।
হ্যাগার্ড পা টিপে টিপে কনজারভেটরির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আওয়াজটা এই ঘরের ভেতর থেকেই আসছে। চলো, দেখে আসি।
ঢোক গিলল কিশোর। মনে হলো জিভ ভারী হয়ে গেছে। মুখের ভিতরটা সিরিশ কাগজের মত খটখটে হয়ে আছে।
ওর দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি হাসল হ্যাগার্ড। চেহারায় ভয় নেই, এসো আমার সঙ্গে ধরনের ভাব ফুটিয়ে ঢুকে পড়ল।
বাধ্য হয়ে তাকে অনুসরণ করল কিশোর।
যে-মুহূর্তে ওরা কনজারভেটরির ভিতরে পা রাখল, ঠিক সেই মুহূর্তে থেমে গেল আওয়াজটা।
মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল ওরা দুজন। তারপর একযোগে ঘুরে তাকাল বর্মটার দিকে।
হ্যাঁ, যেখানে থাকার কথা, সেখানেই বসে আছে ওটা। আবার ঘোড়ার পিঠে ওঠানো হয়েছিল ওটাকে আজ সকালে, ওখানেই নাকি মানায়।
চুপচাপ বসে আছে ওটা একই ভঙ্গিতে। মাথা এদিকে ফেরানো। বর্শাটা এক হাতে উঁচু করে ধরে আছে।
সব স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না কিশোর বা হ্যাগার্ডের।
আমার ধারণা বোধহয় ঠিক না, নিচু স্বরে বলল হ্যাগার্ড। স্বস্তির শ্বাস ফেলল। আর যাই হোক, শব্দটা ভূত করছে না।
দরজার দিকে ঘুরল হ্যাগার্ড। কিশোরও।
এক পা এগোল কিশোর।
এমন সময় ওর মনে হলো কিছু একটা শা করে চলে গেল মাথার উপর দিয়ে। মাথার এত কাছ দিয়ে গেল যে ওর চুল পর্যন্ত দুলে উঠল।
হ্যাগার্ডও টের পেয়েছে ব্যাপারটা।
মুহূর্তে চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার। পরমুহূর্তে কিছু একটা বিস্ফোরিত হওয়ার আওয়াজ হলো।
লম্বা একটা তীর ফুলের টবগুলোর একটায় আঘাত হেনেছে। তীরটা ভিতরের মাটিতে গেঁথে গেছে ত্রিশ ডিগ্রি কোনাকনি হয়ে। লেজটা তিরতির করে কাঁপছে।
একটা ক্রস-বো থেকে ছোঁড়া হয়েছে ওটা। কিশোর জানে আড়াইশো বছর আগে যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সৈন্যরা এসব আড়ধনু ব্যবহার করত।
হ্যাগার্ড আর কিশোর একযোগে পিছন দিকে তাকাল।
ওটা যে নেজার ম্যাণ্ডারই ছুঁড়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইল ওরা।
১৪
জলদি পালান! হ্যাগার্ডের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠেই সামনে ছুটল কিশোর। পিছনে খুরের আওয়াজ উঠল আবার।
এগিয়ে আসছে আওয়াজটা।
দ্রুত কমে আসছে ঘোড়া ও কিশোরদের মাঝের দূরত্ব।