অসম্ভব।
মিস্টার পারকারের চোখজোড়া চকচক করছে।
বাবা, সত্যিই যদি ভূতটা থেকে থাকে? ফ্যাকাসে চেহারায় জিজ্ঞেস করল জিনা।
যদি মানে? অবশ্যই আছে।
এগিয়ে এসে জিনার কাঁধে হাত রাখলেন। আরেক হাত রাখলেন কিশোরের কাঁধে। আমি সফল হতে চলেছি! চাপা স্বরে বললেন।
ভূত বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেব আমি। ভূত আছে বিজ্ঞানীরা সেটা স্বীকার করবে এরপর!
দোতলায় উঠে এল সবাই। পারকার আঙ্কেল নিজের রুমে ঢুকলেন। বিড়বিড় করে আন্টি তাঁকে কী যেন বললেন। জিনা চলে গেল নিজের রুমে। করিডর ধরে কিশোর এগিয়ে গেল ওর রুমের দিকে।
একা হতে কেমন অস্বস্তি লেগে উঠল ওর। নিজেকে জিজ্ঞেস করল, ভয় করছে তোমার?
অন্তর থেকে কোনও জবাব নেই।
এখন কী করা উচিত ভাবতে চাইল ও? কয়েক মুহূর্ত পর বুঝল, যা করার ওকেই করতে হবে।
কিন্তু সেটা কী?
পারকার আঙ্কেলকে কিছুতেই বোঝানো গেল না বর্মটা কতখানি বিপজ্জনক।
কিশোর বুঝতে পারছে, কিন্তু কাউকে বোঝানো গেল না।
মাথার ভিতরে একশো মাইল বেগে দুইশো রকমের চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে ওর।
ক্লান্তি লাগছে।
মন বিষণ্ণ।
সামনেই ওর রুম। এমনসময় একটা আওয়াজ কানে এল। কান। খাড়া করল কিশোর।
আবারও শোনা গেল আওয়াজটা।
অস্পষ্ট।
শব্দটা কিসের বুঝতে পেরেছে কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে ওর ঘাড়ের সমস্ত রোম দাঁড়িয়ে গেল।
ঘোড়ার খুরের আওয়াজ ওটা।
১৩
পরদিন।
জিনার সাথে ওদের স্কুলে এল কিশোর। গোবেল বিচ গভর্ণমেন্ট হাই স্কুল। রকি বিচের স্কুলগুলোর মত অত কড়াকড়ি নেই এখানে।
জিনার সঙ্গে ওর ক্লাসরুমে, ছেলেদের দিকটায় বসল কিশোর। বেশ কজন টিচারের সঙ্গে পরিচয় হলো। লস অ্যাঞ্জেলেসের একটা স্কুলে পড়ে বলেই কিনা কে জানে, সবারই খাতির পেল ও।
ভাল লাগল স্কুলটা।
স্কুল থেকে ফিরে সোজা ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল দুজন।
খাওয়া শেষ হতে জাদুঘরে ঢুকল কিশোর, হ্যাগার্ডের সঙ্গে দেখা করবে।
পারকার আঙ্কেল ওর কথায় কান দেননি, কিন্তু কিশোর জানে হ্যাগার্ড দেবে। লোকটা অন্যরকম। বক্তা হিসেবে তার তুলনা নেই, দেখা যাক শ্রোতা হিসেবে কেমন।
কনজারভেটরিতে পাওয়া গেল তাকে। নেজার ম্যাণ্ডারের বর্মের কাছে বসে কাজ করছে।
কিশোর দেখল আবারও স্বাভাবিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে ঘোড়ার ডামির পিঠে চেপে আছে বর্মটা।
বর্মের তলোয়ারটা পালিশ করছে হ্যাগার্ড।
কিশোর ভেতরে ঢুকতে মুখ তুলে তাকাল সে। হাসল।
আপনার সঙ্গে জরুরি কথা ছিল, গম্ভীর কণ্ঠে বলল কিশোর।
খুব জরুরি। আপনি তো ওটার ব্যাপারে সবই জানেন।
কীসের ব্যাপারে? ভুরু কুঁচকে উঠল কেয়ারটেকারের।
বর্মটার ব্যাপারে, বলল ও। নেজার ম্যাণ্ডারের ব্যাপারে আপনি যা বলেছেন, সব সত্যি।
সারও তা-ই বলছিলেন, মাথা ঝাঁকাল লোকটা। আগামী শনিবার জাদুঘর উদ্বোধন করা হবে। বড় ধরনের আয়োজন করা হচ্ছে।
হেনরি রব হ্যাগার্ডের পাশে বসে পড়ল কিশোর।
সত্যিই! অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকাল ও। এখনও সময় আছে। উদ্বোধনের আগে বর্মটার ব্যাপারে কিছু একটা করা দরকার, না হলে বড় ধরনের বিপদ ঘটে যেতে পারে।
অবাক হলো কেয়ারটেকার। কী হয়েছে খুলে বলো তো।
লম্বা শ্বাস টানল কিশোর। অন্তত একজন ওর কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনতে চেয়েছে। যেভাবে হোক, বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচাতে হবে পারকার আঙ্কেলকে।
আগামী শনিবার জাদুঘর উদ্বোধন করা হবে। কিন্তু তার আগে। নেজারের ব্যাপারে কিছু ফয়সালা করতে হবে।
নইলে…
হ্যাগার্ডকে গতকাল রাতের পুরো ঘটনা খুলে বলল কিশোর। কিছুই বাদ দিল না।
বলে চলেছে কিশোর, বড় হতে থাকল হ্যাগার্ডের চোখ জোড়া। কিশোরের কথা যখন শেষ হলো, তার দুচোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে প্রায়।
অবাক হয়েছে হ্যাগার্ড, তবে চেহারায় উত্তেজনার চিহ্ন নেই। মিস্টার পারকারের মত উত্তেজিত হয়নি সে।
খানিকক্ষণ ঝিম্ মেরে থাকল লোকটা। আপনমনে মাথা দোলাল, গোঁফে তা দিল। ভুরু জোড়া কুঁচকে গেল।
চোয়াল শক্ত।
কিশোরের বুঝতে অসুবিধে হলো না গভীর চিন্তায় ডুবে আছে কেয়ারটেকার।
একটু পর ঝট করে উঠে দাঁড়াল হ্যাগার্ড। কিশোরও উঠে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে। ওর কাধ চাপড়ে লোকটা বলল, তোমার নিজেকে নিয়ে গর্ব করা উচিত, কিশোর। ভয়ঙ্কর বদ এক সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়েছ তুমি। তাকে হারিয়ে দিয়েছ। বাঁচিয়ে দিয়েছ আমাদের সবাইকে।
কিন্তু আবার যদি জেগে ওঠে ওই আত্মা? দ্বিধা করে বলল ও। এমন কি হতে পারে না ওই অতৃপ্ত আত্মা নতুন সুযোগের অপেক্ষায় আছে?
হুঁম! চিন্তিত ভঙ্গিতে গোঁফের, কোণা মোচড়াল হ্যাগার্ড। কী হতে পারে আমি জানি না, কিশোর। তবে এ কথা বলতে পারি কিছু সময়ের জন্যে হলেও যোদ্ধার আত্মাকে অক্ষম করে দিয়েছ তুমি। বর্মটার দিকে তাকাল সে সরু চোখে। এখন ওটাকে দেখে চুপচাপ মনে হচ্ছে, যেন কিছু বোঝে না।
বর্মটার দিকে তাকাল কিশোরও। এটাই যে গতকাল রাতে ওর আত্মা উড়িয়ে দিয়েছিল, দেখে বোঝার উপায় নেই এখন।
চোখের দুই ফোকর দিয়ে যে ভুতুড়ে আলো বের হয়েছে, তা এখন অবিশ্বাস্য মনে হয়।
সত্যিই এখন বর্মটাকে ভদ্র মনে হচ্ছে।
নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর।
হ্যাগার্ড হয়তো ঠিকই বলেছে। হয়তো কিছু সময়ের জন্য ও নেজারের প্রেতাত্মাকে দমিয়ে দিয়েছে।
অথবা কে জানে, হয়তো চিরদিনের জন্য।