বর্মটার ব্রেস্টপ্লেটের ঠিক মাঝে একটা বড়সড়, গভীর ট্যাপ চোখে পড়ল ওর। ওখানেই আঘাত করেছে পাথরটা।
কিশোরের উত্তেজনা একটু একটু করে কমে আসছে। শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসছে ওর। প্রাণ ভরে শ্বাস টানল ও। মনে হলো অনেক দিন পর সজীব বাতাস ঢুকল ওর ফুসফুসে। কী শান্তি!
কিচেন-টেবিলের নীচে পাথরটা পড়ে আছে। এগিয়ে উবু হয়ে ওটা তুলে নিল ও। যতটা ভেবেছিল তার চেয়েও অনেক হালকা ওটা। এরকম একটা জিনিস কোনওমতেই ভারী বর্মধারী এক যযাদ্ধার ভূতকে ধরাশায়ী করবে না।
ও হেরে গেছে! বিড়বিড় করে বলল ও। কিন্তু কী করে? আমি তো কিছুই জানি না! প্রাণে বেঁচে গেছে ভাবতে গিয়ে খুশি হয়ে উঠল কিশোর।
কিশোর! একটা পরিচিত কণ্ঠ করিডর থেকে ভেসে এল। পরমুহূর্তে কিচেনে ঢুকলেন মিস্টার পারকার, সঙ্গে জিনা। ভাবনার জাল ছিন্ন হলো ওর। এত রাতে এখানে কী করছ তুমি? শুতে যাওনি কেন?
কেন শুতে যাইনি বলব পারকার আঙ্কেলকে? ভাবল ও।
কিন্তু মুখ খোলার সুযোগ পেল না। সুইচ টিপে বাতি জ্বেলে দিলেন মিস্টার পারকার। শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। কিশোর।
সামনে নজর পড়তে খাবি খেলেন মিস্টার পারকার। চেহারা সাদা হয়ে উঠল।
মেঝেতে পড়ে থাকা বর্মটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। বিস্ময়ে ঝুলে পড়েছে চোয়াল।
মিস্টার পারকার কী ভাবছেন, কিশোর জানে। মুখ ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালেন তিনি। তাঁর চাউনি দেখে কিশোরের আত্মা উড়ে গেল।
নেজার ম্যাণ্ডার কিশোরকে খুন করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। মিস্টার পারকারের চাউনি দেখে ওর মনে হচ্ছে করলেই ভাল ছিল।
পারকার আঙ্কেলকে ও কী করে বোঝাবে…
কিশোর! গমগমে কণ্ঠে হুঙ্কার ছাড়লেন মিস্টার পারকার। আমি তোমাকে ওটা থেকে দূরে সরে থাকতে বলিনি? বর্মটা ইঙ্গিত করলেন।
এক মুহূর্ত কেশে নিয়ে কিশোর বলল, আঙ্কেল, আসলে আমার কোনও দোষ নেই। যা ভাবছেন…
এ সব দোষ ওই বাদুড়টার, ওর কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল জিনা। বুকের উপর দুহাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়েছে বাবার পাশে। চেহারা দেখেই বোঝা গেল কিশোরের দুরবস্থা দেখে একটু মজাই পাচ্ছে যেন ও। আসলে তোমাকে যে বাদুড়টার কথা বললাম না, বাবা, ওটাই সব নষ্টের গোড়া। ওটা দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গেল। কিশোর। নিশ্চয়ই সারাবাড়ি ছোটাছুটি করেছে এতক্ষণ। তাতেই লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সব। এমন কী বর্মটাও রেহাই পায়নি, দেখো।
খুলে বলো সব, কিশোর, গম্ভীর স্বরে বললেন মিস্টার পারকার।
জিনা, একটু আগে আমাকে একা ফেলে চলে গেল, বলল কিশোর। তখন থেকে যা ঘটেছে… আঙ্কেল, নেজার ম্যাণ্ডারই গণ্ডগোল শুরু করে। আমাকে দাবড়ে বেড়িয়েছে এতক্ষণ। বার বার বলেছে আমি নাকি এক শয়তান জাদুকর। গদা, তলোয়ার দিয়ে আমাকে মারার চেষ্টা করেছে…
থেমে গিয়ে মিস্টার পারকারের দিকে তাকাল কিশোর। প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করছে। পারকার আঙ্কেল কি ওর কথা আদৌ বুঝতে পারছেন? বুঝলেও বিশ্বাস করছেন?
নাকি…
হঠাৎ কিশোরের মনে হলো পারকার আঙ্কেলের চেহারা থেকে। ঘুম-ঘুম ভাবটা উধাও হয়ে গেছে। চশমার পিছনে তার চোখজোড়া বড় বড় হয়ে উঠেছে।
উৎসাহে?
নাকি বিস্ময়ে?
কে জানে!
ভূত! এগিয়ে এসে ওর কাঁধ আঁকড়ে ধরলেন উনি।
যোদ্ধার ভূত! খুশিতে চক করে উঠল তাঁর দুচোখ। এই নিয়েই তো গবেষণা করছেন তিনি। ওটা ছুটোছুটি করেছে? তোমাকে দাবড়ে বেড়িয়েছে, কিশোর?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
পারকার আঙ্কেল ওর কথা বিশ্বাস করেছেন বুঝতে পেরে খুশি।
ওয়াণ্ডারফুল! মিস্টার পারকার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। ওয়াণ্ডারফুল!
আপনি জানেন না ওটা কতটা ভয়ঙ্কর, বলল কিশোর।
ঠিকই বুঝতে পেরেছি আমি। ওটা ভুতুড়ে বর্ম। ওটার মধ্যে আছে এক যোদ্ধার আত্মা। ঠিক না?
বর্মটার দিকে তাকালেন তিনি।
দরজার কাছে পড়ে থাকা ওটার বিচ্ছিন্ন একটা হাত তুলে নিলেন। শূন্যে ঘোরালেন ওটাকে। কী কাণ্ড! কিশোর, জিনা, তোমরা বুঝতে পারছ এর অর্থ কী?
কীসের কী অর্থ, বাবা? জিনা শুধাল।
এই যে বর্মটা, এটা ভুতুড়ে। চকচক করছে আঙ্কেলের চোখ। কত ভূত খুঁজেছেন তিনি। এবার হয়তো একটাকে পাওয়া গেছে। এবার বিজ্ঞান দিয়েই ভূত ব্যাখ্যা করতে পারবেন বিজ্ঞানীদের কাছে।
এক পা এগিয়ে এল কিশোর। আঙ্কেল, শুনুন। ওটা কেবল ভুতুড়ে বর্মই নয়, বিপজ্জনকও। আরেকটু হলে ওই যোদ্ধার ভূত আমাকে মেরেই ফেলেছিল। তখনই…
থেমে গেল কিশোর। আঙ্কেল ওর কথা শুনছেন না। তাকে কখনও এতটা উত্তেজিত হতে দেখেনি কিশোর।
আশ্চর্য মানুষ!
কিশোর, ও কি সত্যি ওই ঘোড়ায় উঠে বসে ছিল? ওখান থেকে নিজেই নেমে এসেছে? মিস্টার পারকারের চোখে-মুখে চরম উত্তেজনা। চেহারায় আগ্রহ। হেঁটেছে? সত্যিই কথা বলেছে?
হতাশায় কাঁধ ঝুলে পড়ল কিশোরের। হ্যাঁ, হেঁটেছে, জবাব, দিল। কথাও বলেছে। তারপর ওই তলোয়ারটা দিয়ে আমাকে ফালা। ফালা করতে চেয়েছে।
মিস্টার পারকার আনমনা হয়ে উঠলেন। ঘুরে বর্মটার দিকে তাকালেন।
চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল কিশোর, ভূতটা বর্মের মধ্যে আছে। ওটার হাত থেকে আমাদের কারও রেহাই নেই। আমাদের খুন করবে ওটা।
মৃদু হাসলেন মিস্টার পারকার।
ব্যাপারটার গভীরে যাওয়ার কোনও চেষ্টাই করলেন না।
হয়তো ভাবছেন, একটা ভূত বড়জোর ভয় দেখাতে পারে। তাই বলে খুন খারাবি?