ব্যস এটুকুই। আর কিছু হয়নি ওটার।
অথচ বারোটা বেজে যাওয়ার কথা ওটার। নিজের সৌভাগ্য দেখে নিজেই অবাক হলো ও।
হচ্ছেটা কী এসব?
প্রচণ্ড এক হুঙ্কার ছেড়ে হাতের অকেজো গদাটা ছুঁড়ে মারল যোদ্ধা। গর্জে উঠল, কোনও জাদুমন্ত্রে এবার কাজ হবে না। এবার আমার হাতেই তোমার মরণ লেখা আছে।
নেজারের অন্য ধাতব হাতে এখনও শোভা পাচ্ছে তলোয়ারটা।
ওটা উঁচিয়ে কিশোরের দিকে এগোল। হুমকি দেয়ার ভঙ্গিতে শূন্যে তলোয়ার চালাল সে। চাঁদের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল ভয়ঙ্কর অস্ত্রটা।
মাথা নোয়াল কিশোর।
এখন কী হবে?
পালাও! ভিতর থেকে দ্বিতীয় কিশোর বলল ওকে। শিগগির পালাও, কিশোর!
কিন্তু কোথায় পালাবে ও? পিছনের দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে। বর্মটা।
ঘুরে যে-পথ দিয়ে ও এসেছিল সে-পথেই হাঁটতে শুরু করল। আবার। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। কিচেনের দিকে যাবে।
পিছনে ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ উঠল।
ভারী ঢালটা ছুঁড়ে ফেলে দিল কিশোর। তারপর দৌড়াতে শুরু করল। টের পেল দম নিতে সমস্যা হচ্ছে। গলা শুকিয়ে গেছে। ঢোকও গেলা যাচ্ছে না।
পিছনের শব্দ ওকে জানান দিল খুব কাছে এসে পড়েছে বর্মবন্দি। পিছনে না তাকিয়েও মনের চোখ দিয়ে দেখতে পেল ওর দিকে লম্বা
একটা ধাতব হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ওটা। যে-কোনও মুহূর্তে ওর ঘাড় ধরবে ওই হাত।
জোর ঠেলা দিয়ে দরজাটা খুলেই কিচেনে ঢুকে পড়ল কিশোর। ফ্লোরে ওর স্লিপার পিছলে গেল। পা দুটো নিয়ন্ত্রণ হারাল।
দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে উপুড় হয়ে আছড়ে পড়ল ও। পরমুহূর্তে পিছনে হিশহিশ শব্দ উঠতেই বুঝল হাতে তলোয়ারটা বাতাসে নাচাচ্ছে নেজার ম্যাণ্ডার।
দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করে উঠে বসল ও। কিচেনের ভিতর একটা আইল্যাণ্ড আছে। দেখতে অনেকটা রেস্টুরেন্টের কাউন্টারের মত। এই বাড়িতে আগে ওটাকে রান্নাবান্না ও খাবার পরিবেশনের কাজে ব্যবহার করা হতো। পারকার আঙ্কেল ওটাকে অস্ত্রপাতি পরিষ্কার করার কাজে লাগাচ্ছেন।
চট করে উঠে দাঁড়িয়ে ওটার আড়ালে চলে এল কিশোর।
মাথা নিচু করে সামনে এগোতে লাগল। কাউন্টারের শেষপ্রান্তে পৌঁছে ওর মনে হলো, নেজারের নাগালের বাইরে আসা গেছে।
ধীরে ধীরে মুখ তুলে উঁকি দিল ও সামনে।
বর্মবন্দির অতৃপ্ত আত্মা খেপে উঠেছে। তাকে দমানোর ক্ষমতা। নেই কারও।
তার বিরুদ্ধে কীভাবে লড়বে কিশোর?
রুমটার চারদিকে নজর বোলাল ও চকিতে।
দেয়ালে ঝুলন্ত শেকল?
সে তো অনেক দূরে।
শেকলের পাশে ঝোলানো তলোয়ার?
ওগুলো বড় বেশি ভারী, অন্তত কিশোরের পক্ষে।
এরপরই জিনিসটা চোখে পড়ল কিশোরের।
একটা গুলতি।
ওটা রয়েছে কিশোর আর দরজার মাঝামাঝি জায়গায়। কেন যেন কিশোরের মনে হচ্ছে প্রাচীন ওই গুলতিটা হাতে পেলে জীবন্ত দুঃস্বপ্নটার মোকাবিলা করতে পারবে ও।
হয়তো এ যাত্রা বেঁচে যাবে।
ওদিকে কিশোরের অবস্থান টের পেয়ে গেছে নেজার। তার চোখের আগুন ধধ করে জ্বলছে।
রোবটের মত আড়ষ্ট ভঙ্গিতে এগোতে লাগল বর্মবন্দি। কাউন্টারের ওপাশে পৌঁছে থেমে দাঁড়াল।
প্রথমে তলোয়ারটা শূন্যে তুলল। তারপর কিশোরকে লক্ষ্য করে নামিয়ে আনল।
কাউন্টারের উপর আছড়ে পড়ল ভারী অস্ত্রটা। ওটার কী দশা হলো দেখার জন্য অপেক্ষা করল না ও।
আগেই সরে গেছে জায়গা থেকে। গুলতিটার দিকে দৌড়াল ও দম বন্ধ করে। তলোয়ার তুলে ভয়ঙ্কর হুঙ্কার ছাড়ল যোদ্ধা। দ্রুত শূন্যে চালাতে লাগল ওটা–ডান থেকে বায়ে, বা থেকে ডানে।
ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে এগোতে লাগল।
গুলতির কাছে পৌঁছে গেল কিশোর। সারাশরীর অবশ হয়ে আসছে। ওটা নামানোর জন্য হাত বাড়াল। গুলতিটা যে লিভারে চলে, সেটায় হাত লেগে গেল ওর নিজের অজান্তে। তারপর কোনদিক দিয়ে কী ঘটে গেল, টের পেল না কিশোর।
পরপর দুটো শব্দ কানে এল। প্রথমে টুং তারপর হুশ্শ।
পারকার আঙ্কেল মনে হয় মান্ধাতা আমলের এই গুলতিটায় একটা পাথর আটকে রেখেছিলেন। বর্মটার দিকে ওটাকে ঝড়ের বেগে ছুটে যেতে দেখা গেল।
কিশোর বুঝতে পারল পাথরটা বর্মের গায়ে গিয়ে আঘাত করবে। অবশ্য তাতে যে ওটার তেমন কোনও ক্ষতি হবে না, তা-ও বুঝল। তবু কিশোর খুশি হয়ে উঠল, কারণ দরজার দিকে দৌড়াতে যেটুকু সময় দরকার, তা হয়তো পাওয়া যাবে এর ফলে।
পালানোর একটা সুযোগ তাতে মিলেও যেতে পারে।
পাথরটা নেজারের বুকে আঘাত করল।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কিশোর। ছুট লাগানোর এখনই সময়।
চোখের কোণ দিয়ে দেখল টলে উঠেছে বিশাল বর্মটা। দুবাহু। শূন্যে উঠে গেল নেজারের। হাতের তলোয়ারটা সশব্দে আছড়ে পড়ল মেঝেতে।
মাথা তুলল প্রেতাত্মা।
কিশোরের দিকে তাকাল সরাসরি।
চোখের আগুন অগ্নিগিরির জ্বালামুখের মত বিস্ফোরিত হলো।
পরমুহূর্তে কান ফাটানো আওয়াজ তুলে মেঝেতে আছড়ে পড়ল প্রকাণ্ড বর্মটা।
নিশ্চপ, নিথর হয়ে পড়েই থাকল।
১২
ব্যাপার কী? ভাবল কিশোর।
সামান্য একটা পাথরের আঘাতে কাবু হয়ে গেল অমন একটা বর্ম?
না, হতেই পারে না। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও গড়বড় আছে।
গুলতিটার কাছ থেকে সরে সামনে এগোল কিশোর। ভাল করে বর্মটার দিকে তাকাল।
চার হাত-পা চারদিকে ছড়িয়ে আছে। হেলমেট কাত হয়ে আছে। একদিকে। মুখাবরণের উপরের ফাঁক দুটোর দিকে তাকাল কিশোর।
কী দেখল?
কিছুই না।
কিছুই দেখা গেল না ভিতরে।
অন্ধকার।