নেজার ম্যাণ্ডার গলাটা নিচু করে আবার তুলল। ধাতব, খ্যানখেনে গলায় পৈশাচিক হাসি দিল।
বহু কষ্টে আরেক পা পিছাল কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে ওটাও এগিয়ে এল এক পা। যেন মাঝখানের ব্যবধান কিছুতেই বাড়তে দিতে রাজি নয়।
আচমকা হাতের বর্শাটা একদিকে ছুঁড়ে মারল নেজার। জোরাল ঠঠ শব্দ তুলে মেঝেতে আছড়ে পড়ল ওটা।
যাক! মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করেছে, ভাবল কিশোর। হাঁপ ছাড়ল।
আরেক পা সামনে এগোল ওটা।
আজকের এই দিনটির জন্যে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অপেক্ষা করে আছি আমি। তোমাকে তিলে তিলে মারব আমি, জাদুকর! দুচোখ ভরে দেখব তোমার মরণ-যন্ত্রণা, তার ভারী কণ্ঠস্বরে পৈশাচিক রুক্ষতা।
ভয়ে জমে গেল কিশোর।
ওকে বিশ্বাস করেনি নেজার!
মুক্তি দেয়নি!
অনেক কষ্টে মুখ তুলে চাইল কিশোর উপর দিকে।
নড়ার শক্তিও নেই দেহে।
চারদিকে নজর বোলানোর ফাঁকে কিশোর বুঝল লুকানোর জায়গা নেই কোথাও। নেজারের হাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব নয়।
মধ্যযুগের যত অস্ত্র আছে মিস্টার পারকারের সংগ্রহে, ঘোড়ার ডামিটার চারদিকে সাজিয়ে রাখা আছে সেসব। ওগুলোর দিকে নজর যেতে ঢোক গিলল ও।
নেজারের হাত থেকে আজ ওর রেহাই নেই।
পারকার আঙ্কেলের এই কনজারভেটরির মধ্যেই তা হলে ওর মরণ লেখা ছিল।
এটা দরকার আমার, লম্বা একটা তলোয়ার তুলে নিয়ে বলল নেজার। এটাও, আরেক হাতে তুলে নিল দশাসই এক গদা।
জিনিস বটে একখানা!
যেমন বিদঘুঁটে, তেমন ভারী। ওটার মাথার অসংখ্য চোখা পেরেক মারমুখো করে পোতা রয়েছে অনেকটা টুথব্রাশের ব্রিসলের মত। তবে অত ঘন নয়। তাতে অবশ্য কিছু আসবে যাবে না। এক ঘা খেলেই কম্ম কাবার।
চক্চক্ করছে গদার পেরেকগুলো। থেকে থেকে ঝিকিয়ে উঠছে। তলোয়ার।
কিশোর ভয়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। ওই গদার পেরেকঠাসা মাথার একটা খোঁচা খেলে কেমন লাগবে ভাবতে গিয়ে গায়ের তাপমাত্রা শূন্যের কোঠায় নেমে গেল।
শুনুন! আচমকা চড়া গলায় চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। হঠাৎ এত শক্তি কোত্থেকে এসে ভর করল গলায়, ভেবে নিজেই অবাক হলো। মারার আগে বাঁচার শেষ চেষ্টার সময় সবারই বোধহয় এমনই বেড়ে যায় জোর। আপনি তো একজন যোদ্ধা, তা-ই না? নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে একজন সত্যিকারের যোদ্ধা কখনও নিরস্ত্র কাউকে আক্রমণ করে না?
বর্মটার মুখাবরণের ভিতরের লাল আগুন লল করে উঠল।
ঠিক বলেছ, একমত হলো যোদ্ধার ভূত। আমি কখনও নিরস্ত্র কাউকে আক্রমণ করিনি। কয়েক পা পিছাল। তারপর এক হাতে ইশারায় দেয়ালে ঝোলানো অস্ত্রসম্ভার দেখাল কিশোরকে। ওখান থেকে বেছে নাও যা খুশি।
দুহাত কাঁপছে কিশোরের।
বুকের মধ্যে অনবরত হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে।
কোনওমতে এগিয়ে একটা ঢাল তুলে নিল ও। ঢালটা বেশ বড় আর ভারী। দুহাতে জিনিসটা ধরে ওটা দিয়ে মাথা আড়াল করল।
বাহ্! ভাবল ও। আত্মরক্ষার ভাল একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল।
কিন্তু নেজার ম্যাণ্ডার আরও খেপে উঠল। জলদি অস্ত্র বেছে নাও!
তার ভারী ও চড়া নির্দেশে চমকে উঠল কিশোর। ঢালের আড়াল থেকে মাথা তুলল। তারপর কাঁপা হাতে মাঝারি আকারের একটা গদা তুলে নিল।
ঢালটা বাঁ হাতে ধরেছে, গদা ডান হাতে।
মনে হচ্ছে ও দুটোর ওজন কয়েক টন করে হবে। ধরে রাখতেই জান বেরিয়ে যাবার দশা হলো কিশোরের। দুই হাত টন্ট করে উঠল।
লড়বে কীভাবে?
লড়ার চেষ্টা করার সুযোগ পাবে তো?
নেজার ম্যাণ্ডার মাথা পিছনে হেলিয়ে হো-হো করে হেসে উঠল। অপার্থিব হাসি।
লড়াই শুরু হলো।
ঢালের উপর দিয়ে উঁকি দিল কিশোর।
প্রেতাত্মাকে তার গদাটা মাথার উপরে ওঠাতে দেখল ও।
কিশোরের মাথা সই করে দ্রুত নেমে আসতে লাগল ওটা।
চোখা পেরেকগুলো বাতাসে শিস কেটে নীচে নেমে আসার সময়। চাঁদের আলোয় ঝিকমিক করে উঠল।
বিজাতীয় একটা আওয়াজ করে কিশোর শক্ত হাতে ধরল ঢালটা। আগেই মাথা নিচু করে রেখেছে। শরীরের প্রতিটি পেশি টাটা হয়ে উঠেছে।
ওর ঢালে গদার বাড়ি পড়তেই গোটা দেহ কেঁপে উঠল। লোহার সঙ্গে লোহার ঘর্ষণে ফুলঝুরির মত স্ফুলিঙ্গ ছুটল।
একইসঙ্গে ঝন্ঝন্ জাতীয় একটা শব্দ কানে এল ওর। দ্বিতীয় আঘাত কিশোরের ঢাল যে সইতে পারবে না সে-ব্যাপারে কোনও ভুল নেই।
প্রাণের আশা ছেড়ে দিল কিশোর। বুঝতে পারছে, আসলেই ও হেরে গেছে।
১১
দম বন্ধ করে রেখেছে কিশোর। নিজের হৃৎস্পন্দন শুনছে। শেষ হৃৎস্পন্দন।
বড়জোর আর কয়েক সেকেণ্ড আয়ু আছে ওর। গদার আঘাতে হাড়-মাংস থেঁতলে যেতে আর দেরি নেই।
তারপর সব শেষ।
এক।
দুই।
আড়াই সেকেণ্ড
পৌনে তিন…
কই, কিছুই তো ঘটল না।
ধীরে ধীরে কচ্ছপের মত মাথা তুলল ও ঢালের কিনারা দিয়ে। নিজের ঢালটা ভাল করে দেখল। এখনও অক্ষত আছে, ওটা।
ওর কয়েক পা দূরে বর্মটাকে দেখা গেল। নেজারের চোখবিহীন, চোখের দুই ফুটো নিজের গদার উপর স্থির।
কিশোরও তাকাল ওটার দিকে।
মানে গদাটার অবশিষ্টাংশের দিকে।
কিশোর ওর ঢালটা ধরে রেখেছিল শরীর আড়াল করে, নেজারের গদা আঘাত হেনেছিল ওটায়, আর তাতে ভেঙেচুরে অগুনতি টুকরোয় পরিণত হয়েছে তার গদা। ওটার তীক্ষ্ণ পেরেকগুলো খুলে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে আছে।
নেজার যখন অবাক বিস্ময়ে নিজের ভাঙা অস্ত্রের দিকে চেয়ে আছে, কিশোর তখন মাথা তুলে সামনে ঝুঁকে ওর ঢালের সামনের দিকটা দেখে নিল। বড়সড় একটা ট্যাপ চোখে পড়ল।