টেনে খুলল দরজাটা। কাঁচকোচ শব্দ তুলল জং ধরা কবজা।
উঁকি দিল ভিতরে।
নেজার এখনও আছে ওখানে–ডামি ঘোড়াটার পিঠে। তখন যে অবস্থায় দেখে গিয়েছিল ও, সেই অবস্থাতেই আছে।
তবু আশ্বস্ত হতে পারল না কিশোর। মনের খুঁতখুঁতে ভাবটা কিছুতেই গেল না।
মিস্টার পারকারের লাগানো গাছগুলোর পাশে চলে এল। কিশোর। তারপর ওগুলোর ভিতর দিয়ে সাবধানে সামনে এগোল।
বেড়ালের মত নিঃশব্দে। কেন যেন মনে হচ্ছে শব্দ করা ঠিক হবে না।
বর্মটাকে পেরিয়ে যাবার পরও যখন অস্বাভাবিক কিছু ঘটল না, তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও।
আর কয়েক কদম দূরেই রয়েছে কাক্ষিত দরজা। ওটার কাছে পৌঁছতে পারলেই আর কোনও সমস্যা থাকবে না।
এগিয়ে চলল কিশোর। প্রায় নাগালের মধ্যে এসে পড়েছে। দরজা। আর তিন কি চার কদম…
এমন সময় পিছনে অদ্ভুত একটা শব্দ উঠল।
ক্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-চ!
কিশোরের হাত-পায়ের শিরায় শিরায় শিহরণ জাগল। বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড লাফ দিল।
এগিয়ে যাও, কিশোর, নিজেকে বলল ও। ভুলেও পেছন ফিরে তাকিয়ো না। যেভাবেই হোক ওই দরজার কাছে তোমাকে পৌঁছতেই হবে।
কিন্তু না, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না ও, কৌতূহলের কাছে হেরে গেল আরেকবার। থেমে দাঁড়িয়ে ঘুরে তাকাল।
এবং যা দেখল, তাতে এক লহমায় গায়ের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমে গেল। পরপর দুটো বিট মিস করল হৃৎপিণ্ড।
নেজারের বর্ম!
কিশোরের ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে!
ওর পাশে উঁচু একটা টাওয়ারের মত লাগছে ওটাকে।
বর্মটা ঘোড়া থেকে নামল কীভাবে?
শব্দ করে ঢোক গিলল কিশোর। গলা-বুক শুকিয়ে কাঠ।
কণ্ঠতালু খটখট করছে। বোঁ-বোঁ করছে দুকান।
বর্মের মুখাবরণের উপর দিকের চোখের সরু দুই ফাঁক দিয়ে ভয়ঙ্কর লাল আভা বেরোচ্ছে! দেখতে দেখতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল!
হঠাৎ করে চরম সত্যি কথাটা উপলব্ধি করল কিশোর। এই বর্মের ভিতরে নেজারের ভূত রয়েছে!
ওটা আরও এক কদম সামনে বাড়তে আবার কাঁচ-কাঁচ শব্দ উঠল। নীরব রাতে ভয়ঙ্কর শোনাল সে-আওয়াজ।
নিজের অজান্তে পিছিয়ে গেল কিশোর।
মনে হচ্ছে সময় যেন থমকে গেছে।
আমি বিশ্বাস করি না, ফিসফিস করে বলল কিশোর। আরও কিছু বলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো ও। পা দুটোকে স্বাভাবিক রাখার মরিয়া চেষ্টা চালাল।
কিন্তু পারছে? না। বুক ধকধক করছে।
বর্মের একটা ধাতব বাহু ধীরে ধীরে শূন্যে উঠতে লাগল। অভিযোগের ভঙ্গিতে তর্জনী খাড়া ওটার। আঙুলটা কিশোরের দিকে তাক করে রেখেছে নেজার!
হাতটার দিকে চেয়ে আছে কিশোর। বিস্ময়ে দুচোখ বিস্ফারিত।
এবার! ভারী একটা কণ্ঠস্বর গমগমিয়ে উঠল বর্মের ভিতর থেকে। এবার আমার হাত থেকে তোমার রেহাই নেই, শয়তান জাদুকর!
১০
অ্যাঁ? হাঁ হয়ে গেল কিশোর। কী… কী বলছেন আপনি? আমি জাদুকর?
হ্যাঁ। তুমি-ই সেই শয়তান জাদুকর। ভেবেছ আমার চোখে ধুলো দিয়ে এবারও আমাকে ফাঁকি দেবে? তোমার সে আশা মিথ্যে!
এসব কী বলছেন আপনি? মরিয়া হয়ে বলার চেষ্টা করল কিশোর। জাদুকর হতে যাব কেন আমি? আমার নাম কিশোর। বান্ধবীর বাড়িতে বেড়াতে এসেছি।
চুপ করো! খ্যাকানি মারল নেজার। ওই পাপী মুখে আর কত মিথ্যে কথা বলবে তুমি? জাদুর বলে আমাকে তুমি বন্দি করে রেখেছ এই বর্মের মধ্যে।
আমি?বলল কিশোর। প্রবলভাবে মাথা দোলাল। বুকের উপর নীল লকেটটা দুলে উঠল পেণ্ডুলামের মত।
ওটার ভেতরকার নীল ধোঁয়ার মেঘ আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে।
পাক খাচ্ছে অবিরাম।
আপনি ভুল করছেন, বলল কিশোর। আর কারও সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলছেন। আমি সত্যি জাদুকর নই। এর আগে কোনওদিন আপনাকে দেখিনি। বিশ্বাস করতে পারেন, আমি…
চুপ করো! আবারও গর্জে উঠল বর্মবন্দি। ভিতরের আগুন লকলক করে উঠল। মাথাটা সামান্য নোয়াল সে।
ভিতরে কয়েকশো পাউণ্ড জঞ্জাল থাকা সত্ত্বেও ক্ষিপ্র গতিতে আগে বাড়ল ওটা। যত শক্তিশালীই হোক, কোনও মানুষ এত দ্রুত নড়তে পারবে কি না সন্দেহ।
হাতের বর্শাটার উঁচাল প্রান্ত কিশোরের গলায় ঠেকাল নেজার। মরার জন্যে তৈরি হও, শয়তান! চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
বর্শার আলপিনের মত চোখা প্রান্ত কিশোরের গলার চামড়া ফুটো করে দিল।
ভীষণ গরম ঠেকল জিনিসটা।
ভূতটা কিশোরকে খুন করতে চায়!
গলা চিরে ফেলতে চায়!
তারপরও নেজার ম্যাণ্ডারের মনের জ্বালা জুড়াবে বলে মনে হয় না।
তার মত পূর্ণবয়স্ক যোদ্ধার কাছে কিশোর কী-ই বা! কিছুই করার নেই ওর।
তা-ও লোকটা জীবিত হলে একটা কথা ছিল।
মৃত সে।
অশরীরী।
অনেক কষ্টে ঢোক গিলে দুকদম পিছিয়ে গেল কিশোর।
সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এল বর্মবন্দি। দুর্বোধ্য এক গোঙানি ছাড়ল। মুখাবরণের অগ্নিশিখা সাপের চেরা জিভের মত লকিয়ে উঠল।
ভেবেছ বাচ্চা ছেলের রূপ ধরে আমাকে ধোঁকা দেবে, তা-ই না? গমগমে কণ্ঠে বলল বর্মবন্দি। তুমি যখন ডাইনোসরের রূপ ধরেছিলে, তখন আমি তোমার বিরুদ্ধে লড়েছি। যখন আগুনের দেয়াল হয়েছিলে, তখনও পিছপা হইনি। আর এখন…,
বর্শাটা আবার কিশোরের গলায় ঠেকাল প্রেতাত্মা। আজ আমি প্রতিশোধ নেব। ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ…।
সাহায্যের আশায় চিৎকার করার চেষ্টা করল কিশোর। পারকার আঙ্কেল ও হ্যাগার্ডকে ডাকার চেষ্টা করল।
কিন্তু মুখ দিয়ে টু শব্দও বের হলো না। চাপা গোঙানির মত আওয়াজ বেরোল কেবল। গলায় শক্তিও নেই।