দরজার কাছে পৌঁছে বর্মটার দিকে ঘুরে তাকাল ও। নাহ্, জায়গামতই আছে ওটা।
নেজার নিজের ঘোড়ার পিঠে বসে আছে একইভাবে।
কনজারভেটরি থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। নীচতলার কিচেনে ঢুকল। সামনে এগোল কয়েক পা।
কিচেনের জানালা দিয়ে চাঁদের ভুতুড়ে আলো আসছে। সেই সাথে আসছে শীতল বাতাস। কেন যেন কেমন লেগে উঠল কিশোরের।
দেয়ালে ঝোলানো বড়সড় একটা তলোয়ার চাঁদের আলোয় ঝম করে উঠল। ওটার পাশে ঝুলছে এক সেট ভারী শেকল। শেকলের কড়াগুলোকে প্রাগৈতিহাসিক কোনও জন্তুর দাঁতের মত লাগছে।
ক্ষুধার্ত হিংস্র হায়েনার দাঁতের মত। যেন ওর দিকে তাকিয়ে কটাক্ষের হাসি হাসছে।
শান্ত হও, কিশোর, নিজেকে বলল মনে মনে। অযথা ভয় পাচ্ছ। তুমি। অকারণে ভয় পাওয়ার ছেলে তো তুমি নও। এই বাড়িতে পারকার আঙ্কেল নিজ হাতে একটা জাদুঘর গড়েছেন, ওটা ছাড়া আর কিছুই নেই। এ বাড়িকে তুমি নিজের বাড়ির মতই মনে করো। ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই এখানে।
কফিনটাকে যেমন দেখে গিয়েছিল, এখনও তেমনি আছে।
কোনও রদবদল হয়নি। হওয়ার কারণও নেই।
নাকি হয়েছে?
ড্রাকুলার কফিনের ডালাটা
খোলা ছিল বলে তো মনে হচ্ছে না! যতদূর মনে পড়ে সামান্য ফাঁক হয়ে ছিল ওটা।
ব্যাপার বুঝতে গিয়ে সময় নষ্ট করল না কিশোর। দ্রুত মমিঘরে ঢুকল।
উদাসকে দেখতে পেল প্রথমেই। সবসময় যেখানে থাকে, সেখানেই আছে সে। চোখে সেই উদাস চাউনি। দুই বাহু আগের মতই সামনে বাড়ানো। দশ মমি-আঙুল প্রসারিত।
দ্রুত ওটাকে পেরিয়ে গেল কিশোর, মনে হলো এখনই বুঝি প্রাণ ফিরে পাবে মমিটা, দুহাতে ওকে আঁকড়ে ধরবে।
কিন্তু না, তেমন কিছুই ঘটল না। ঘটার কারণও নেই।
লম্বা করে দম নিল কিশোর।
মমির ধুলো এসে ঢুকল নাকে। কেশে উঠল খকখক করে। দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। মমিঘর থেকে পড়িমরি ছুটে বেরিয়ে এল।
সামনে দরজা। জাদুঘর থেকে বেরোনোর পথ। কাশতে কাশতে ছুটল কিশোর দরজার দিকে।
বাতাস!
বিশুদ্ধ বাতাস দরকার।
দরজাটা প্রকাণ্ড, সাধারণ দরজার প্রায় দ্বিগুণ। অনেকটা কিশোরদের স্কুলের সামনের গেটের মত।
দরজার একপাশে ধাতব হাতল। খুলতে হলে ওটা ধরে ঠেলা দিতে হয়। দরজার হাতল ধরে জোরে ঠেলা দিল কিশোর।
নড়ল না দরজা।
শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে আবার ঠেলা দিল ও।
নাহ্, কাজ হলো না। দরজার ভারী পাল্লা এক ইঞ্চিও নড়ল না।
একহাতে দেয়াল হাতড়াতে লাগল কিশোর। সুইচ খুঁজে পেতে সময় লাগল না। বাতি অন করল। মাথার উপরের বৃত্তাকার টিউব জ্বলে উঠল।
পরমুহূর্তে চোখের সামনে অকল্পনীয় দৃশ্যটা দেখে চোয়াল ঝুলে পড়ল ওর।
শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধই হয়ে এল প্রায়। দরজার দুই হাতলের ভিতর বর্মধারীর একটা তলোয়ার শক্ত করে ভরে দিয়েছে কেউ।
হঠাৎ মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল কিশোরের।
তলোয়ারের হাতল ধরে টানল।
সর্বশক্তি দিয়ে।
দাঁতে দাঁত চেপে।
মরিয়া হয়ে।
কিন্তু চুল পরিমাণ নড়ানো গেল না ওটাকে।
ফাঁদে পড়ে গেছে কিশোর।
৯
ফাঁদে আটকে গেছি! কিশোরের স্বগতোক্তি শূন্য রুমের চার দেয়ালে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলল। নিজের কণ্ঠস্বর নিজের কাছেই ভৌতিক লাগল ওর।
তলোয়ারটার ঠাণ্ডা, কঠিন হাতল শক্ত করে ধরল আবার। বুক। ভরে দম নিয়ে হ্যাঁচকা টান মারল। জোরে।
যত জোরে সম্ভব।
হাত ব্যথা হয়ে গেল। পেশি টন্ করছে, মনে হলো ছিঁড়েই যাবে বুঝি।
মাথার শিরা-উপশিরা দপদপ করছে।
রক্ত চলাচলের গতি বেড়ে গেছে।
কিছু লাভ হলো না। ব্যর্থ হলো ওর চেষ্টা।
হাঁপাতে হাঁপাতে তলোয়ারের হাতলে খানিক দমাদম কিল মারল কিশোর।
তবু কাজ হলো না।
কয়েক পা পিছিয়ে এল ও হাঁপাতে হাঁপাতে। তারপর ছুটে গিয়ে দরজায় কষে লাথি ঝাড়ল।
লাভের লাভ তো কিছু হলোই না, উল্টে ব্যথায় টাটিয়ে উঠল পা। দরজা বা তলোয়ারের গোজ, কোনওটাই নড়ল না।
ফাঁদে পড়ে গেছি!
কথাটা বারবার ওর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল।
যে পথ ধরে এসেছে, সে পথে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই কিশোরের। জাদুঘরের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। তার মানে আবার মমিঘর, কফিনঘর, ভৌতিক কিচেন পেরোতে হবে। ভয়ঙ্কর জিনিসগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে হবে আবার।
কনজারভেটরির শেষপ্রান্তে একটা ব্যাক ডোর আছে। ওটা দিয়ে বেরোনো ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই।
কিন্তু ওই অশুভ রুমটাতে আর যেতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। কোনওমতে ওই দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে তবেই রক্ষে।
না পারলে?
একটু দমে গেল কিশোর। ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। মাথার মধ্যে চিন্তার ঝড়।
কীভাবে বন্দি হলো ও? জিনা তো ওই দরজা দিয়েই বেরিয়ে গেছে মাত্র কয়েক মিনিট আগে। এর মধ্যে তৃতীয় কেউ এসে দরজার হাতলে তলোয়ারটা ভরে দিয়েছে। কিন্তু কেন?
কাজটা কীভাবে সম্ভব হলো?
কাজটা যে-ই করে থাকুক, তাকে তো কিশোরের চোখে পড়ার কথা।
অবশ্যই।
কীভাবে ওর চোখ ফাঁকি দিল সে? তাকে কেন দেখতে পেল না ও?
যত ভাবছে কিশোর, তত জট পাকিয়ে যাচ্ছে মাথার মধ্যে।
পা দ্রুত, চলছে ওর। সেসঙ্গে সমান তালে চলছে চিন্তা।
গলার নীল লকেটটা ডানহাতে চেপে ধরে আছে কিশোর। কেন, নিজেই জানে না। তবে শান্তি, স্বস্তি–দুটোই পাচ্ছে ওটার ছোঁয়ায়। মনে হচ্ছে জিনিসটা ওকে সাহস জোগাচ্ছে। যেন বলছে ভয় নেই, আমি আছি।
কখন জাদুঘর পেরিয়ে এসেছে, বলতে পারে না কিশোর। কনজারভেটরির দরজার সামনে এসে থেমে দাঁড়াল।