হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে জিনা। ভয়ে কুঁকড়ে আছে। মুখে কিছু না বললেও কিশোরের উপর ও যে প্রচণ্ড বিরক্ত, তা ওর চেহারাই বলে দিল।
মুখ তুলল কিশোর। বর্মের মুখের ঢাকনা নিয়ে পড়ল। খোলার। চেষ্টা করল ওটা। কাঁকো শব্দ তুলে খুলে গেল।
অপ্রত্যাশিত শব্দটা কাঁপন তুলল ওর সারা দেহে।
হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। তবে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল ও।
হেলমেটটার মুখোমুখি এখন কিশোর।
কিছুই দেখার নেই ভিতরে।
রাতের চেয়েও নিকষ কালো।
আরও সামনে ঝুঁকে ভিতরে নজর ফেলল কিশোর।
অন্ধকার।
ঘন।
কালিগোলা।
অসহ্য একটা বোটকা গন্ধ নাকে ধাক্কা মারল ওর। যেন পচা জঞ্জালের স্তূপ আছে ভিতরে।
পেটের ভিতর নাড়ি-ভুড়ি পাক খেয়ে উঠল। প্রলম্বিত একটা গোঙানির আওয়াজ কানে এল। কেউ যেন দীর্ঘ একটা টানেলের আরেক মাথায় বসে গোঙাচ্ছে।
আওয়াজটা চড়তে লাগল একটু একটু করে।
দ্রুত ভাবতে চাইল কিশোর। কীসের আওয়াজ?
তীব্র হচ্ছে। প্রলম্বিত হচ্ছে।
কীসের?
কোনও জবাব খুঁজে পেল না।
খানিক পিছনে হেলে দাঁড়াল ও। নড়ে উঠল মইটা। কিশোরের গা কাঁটা দিয়ে উঠল।
কিছু একটা নড়ছে।
হেলমেটের ভিতর!
উঠে আসছে কিছু একটা!
কুচকুচে কালো একটা ছায়া!
তীক্ষ্ণ, প্রলম্বিত গোঙানির আওয়াজটা আরও চড়ছে।
চড়তেই থাকল।
বর্ম নড়ে উঠল। তারপর প্রবলভাবে কাঁপতে শুরু করল।
তীক্ষ্ণ এবং কর্কশ আর্তনাদ করে কালো ছায়াটা ঝড়ের বেগে। বেরিয়ে এল বর্মের ভিতর থেকে।
৮
কিশোরের দিকে ছুটে এল ওটা। মহা আতঙ্কে চোখ বুজে ফেলল ও।
এক জোড়া ডানার ভয়ঙ্কর ফড়ফড় আওয়াজ শুনতে পেল ও মাথার চারপাশে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখল কালো ছায়াটা উড়ে বেড়াচ্ছে ওকে কেন্দ্র করে।
একটু পর সামান্য দূরে সরল ওটা। তারপর তীর বেগে ডাইভ দিল সোজা ওকে লক্ষ্য করে।
আঘাত এড়াতে ঝট করে মাথা নিচু করল কিশোর। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।
এ পর্যন্ত ওর দেখা সবচেয়ে বড়, কালো আর কুৎসিত বাদুড়টা প্রায় ওর মুখের উপর আছড়ে পড়ল।
ভয়ঙ্কর দুটো লাল জ্বলজ্বলে চোখ দেখতে পেল কিশোর, জমে গেল আতঙ্কে।
মুখ হাঁ হলো ওটার। তীক্ষ্ণ সারিবদ্ধ দাঁত বেরিয়ে আছে। ওটার ভয়ঙ্কর নখর দেখে শিউরে উঠল কিশোর। ওকে আক্রমণ করতে তৈরি।
হিংস্র দানবের মত বাদুড়টা ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগমুহূর্তে নিজের অজান্তে দুহাতে মাথা পেঁচিয়ে ধরল ও। তবু শেষরক্ষা হলো না। ওর বাঁ কানে ডানা দিয়ে বাড়ি মারল ওটা।
আউ! ককিয়ে উঠল কিশোর। নড়াচড়ার কারণে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। মই থেকে পা ছুটে গেল সড়াৎ করে। তারপর যা হওয়ার তাই।
সোজা পপাত ধরণীতল।
পড়লে কী করে, কিশোর? জিনা ওর পাশে এসে দাঁড়াল দ্রুত। এক হাত সামনে বাড়িয়ে বলল, বেশি লাগেনি তো? এ হাতটা ধরল না কিশোর। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের চেষ্টায় উঠে দাঁড়াল। ব্যথায় টনটন করছে সারা গা। মনে হলো একটা হাড়ও আস্ত নেই।
দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করার চেষ্টা করল কিশোর।
ডান পায়ের গোড়ালিতে টনটনে ব্যথা, থেঁতলে গেছে যেন মাংস।
ডাইভটা ভালই হয়েছে! তির্যক মন্তব্য করল জিনা। কিন্তু মাছটা ফসকে গেল, এই যা।
লজ্জায় গম্ভীর হয়ে গেল কিশোর।
মাথা নিচু করে পাজামার পিছনটা ঝাড়ল। ওর স্লিপার জোড়া, নেজারের ঘোড়ার পায়ের কাছে পড়ে আছে। পায়ে গলাল ওগুলো।
কমসে কম পঞ্চাশ পাউন্ড হবে বাদুড়টার ওজন, বিড়বিড় করে বলল কিশোর।
ভুরু নাচাল জিনা। গেল কোথায় ওটা? দুহাতে মাথা আড়াল করে ছাদের দিকে তাকাল।
জানি না, জবাব দিল কিশোর। রুমের চারদিকে নজর বোলাল। ওটাকে কোথাও দেখা গেল না।
রাত দুপুরে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা করার কোনও মানে হয় না, জিনা বলল। তুমি থাকো, আমি শুতে চললাম।
যাও, তাৎক্ষণিক জবাব দিল কিশোর।
দ্রুতপায়ে দরজার দিকে এগোল জিনা। রুমের শেষ মাথায়। ছায়াগুলোর মধ্যে হারিয়ে গেল।
কিশোর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে নিজেকে বলল, আগেও বলেছি জিনাটা আসলে ভীষণ ভিতু। দেখলে এখন, সামান্য একটা বাদুড়ের ভয়ে তোমাকে একা ফেলে কেমন সটকে পড়ল?
নাকি অন্য কোনও কারণ আছে?
কী এমন কারণ থাকতে পারে? ভাবল কিশোর মনে মনে।
নেজারের ভূতের ভয়?
কে জানে?
এখানে শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকাটা অনর্থক বলে মনে হলো ওর।
এখানে কি কোনও ভূতের দেখা পেল ও?
না।
দেখল শুধু একটা বাদুড়ের বাঁদরামি।
আবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কিশোর। ক্ষোভ-হতাশা জমল মনে। দরজার দিকে এগোল ধীর পায়ে।
চটা চটাশ আওয়াজ তুলছে ওর স্লিপার।
রুমের মাঝামাঝি পৌঁছে মনে হলো একটা কিছুর নড়াচড়া টের পেয়েছে যেন ও।
হ্যাঁ, ঠিক তাই।
কিছু একটা নড়েছে।
থেমে দাঁড়াল কিশোর। ঘুরে তাকাল বর্মটার দিকে।
চাঁদের আলোয় ঝিক্ করে উঠল কী যেন।
তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ওটার মুখের দিকে।
বর্মের মুখাবরণটা খোলা ছিল না? হ্যাঁ, ভোলাই তো ছিল। বন্ধ হলো কীভাবে? কে করল?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। চোখ ডলল।
না, তা হয় কী করে?
বাদুড়টার আক্রমণের আগ মুহূর্তে কিশোরই হয়তো নিজের অজান্তে ওটা বন্ধ করেছিল। এখন মনে নেই।
হতেও তো পারে।
পারে না?
আর একমুহূর্তও এখানে নয়, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ও। ঘুরে যত দ্রুত সম্ভব পা চালাল।
ফ্লোরে পায়ের আওয়াজ উঠল। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঢিপঢিপ করছে হৃৎপিণ্ড