ভয় করছে? ফিসফিস করে বলল কিশোর। সব কিছু সহজ চোখে দেখার অভ্যেস করো। আমার মনে হয় পারকার আঙ্কেলই ওটাকে এখানে এনে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে রেখেছেন।
মুখে বলল বটে, তবে তেমন জোরাল শোনাল না কণ্ঠ।
অবাক হয়ে লক্ষ করল কিশোর, মধ্যযুগীয় অস্ত্রশস্ত্র জাদুঘরে যা ছিল, তার প্রায় সবই কখন যেন সরিয়ে আনা হয়েছে এখানে।
ঘোড়সওয়ারের বাঁ পাশের দেয়ালে ঝুলছে মিস্টার পারকারের সংগ্রহের বর্শাগুলো। সংখ্যায় প্রায় এক ডজন হবে।
কিশোর দেখতে পেল নেজার ম্যাণ্ডারের ডানদিকের দেয়ালে বড়সড় ধাতব তলোয়ার আর ঢাল ঝোলানো আছে।
এক কোণে দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা একটা নকল বর্মও দেখা গেল।
জাদুঘরের জন্য এটা সংগ্রহ করেছিলেন মিস্টার পারকার। একটু দূর থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই ওটা আসল না নকল। এমনভাবে রং করা হয়েছে যে ওটা যে আসলে সস্তা, পাতলা টিনের তৈরি, তা বোঝা যায় না।
কিশোরের বেশ ভাল লেগেছে জিনিসটা। তবে সত্যিকারের বর্ম জোগাড় হওয়ার পর ওটার গুরুত্ব ও আকর্ষণ দুটোই কমে গেছে।
দেখেছ, পারকার আঙ্কেল কত কিছু এখানে নিয়ে এসেছেন? কিশোর বলল।
জিনাকে চিন্তিত দেখাল। কিন্তু কেন? বলল ও। কখন আনলেন বাবা? আমাদের চোখে পড়ল না কেন?
আমার মনে হয় পারকার আঙ্কেল হঠাৎ করেছেন কাজটা, বলল কিশোর। রুমটা বড় বলে এটাকেও হয়তো জাদুঘরের অংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাদের অজান্তে এখানে নিয়ে এসেছেন এসব।
নেজারের বর্মের দিকে তাকাল গোয়েন্দা-প্রধান। ওটাকে ভয়ঙ্কর। লাগছে, তাই না?
হ্যাঁ, ফিসফিস করে বলল জিনা। ভয়ার্ত চোখে তাকাল ওটার দিকে।
ঘোড়ায় চেপে থাকা বর্মটা দেখে মনে হলো লড়াই করবার জন্য তৈরি ওটা।
একহাতে লম্বা, চুঁচাল ডগার একটা বর্শা ধরে আছে। অন্য হাতে ঘোড়ার লাগাম ও একটা ঢাল।
ধাতব হেলমেট চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে। ঝিলিক মারছে বর্শাটাও।
বর্ম থেকে অদ্ভুত সবুজাভ একটা আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। বর্মের ভিতর থেকেই বেরোচ্ছে।
অবাক না হয়ে পারল না কিশোর।
এ কী করে সম্ভব?
ওটার ভিতরে সবুজ আলো এল কোত্থেকে?
যতটা সম্ভব বর্মের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করল কিশোর। কাছ থেকে ভাল করে দেখার ইচ্ছে। এক পা সামনে এগোতেই পিছন। থেকে ওর হাত টেনে ধরল জিনা। ফিসফিস করে বলল, অ্যাই, কিশোর, কী করছ?
থেমে দাঁড়াল ও। ভাল করে দেখা দরকার।
বাবা যদি জানতে পারেন আমরা এখানে…
কিছুই বলবেন না।
বলবেন, একশো বার বলবেন, কিশোরের মাথার ভিতর থেকে বলে উঠল দ্বিতীয় কিশোর। বর্মটা নিয়ে তোমাকে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে দেখলে পারকার আঙ্কেল রেগে যাবেন। শাস্তি হিসেবে টয়লেটে আটকেও রাখতে পারেন, বলা যায় না। যা রাগী মানুষ! তুমি তো ভাল করেই জানো ওটা পারকার আঙ্কেলের পছন্দের শাস্তি। প্রায়ই জিনাকে টয়লেট-শাস্তি পোহাতে হয়। তোমাকেও ছাড়বেন না, যদি… কি আমি তো পারকার আঙ্কেলের কোনও ক্ষতি করছি না, দ্বিতীয় কিশোরের উদ্দেশে বলল ও। আমি শুধু একটু কাছ থেকে বর্মটাকে দেখতে চেয়েছি, ব্যস। দেখব ওটার ভেতর থেকে কেন ওই সবুজ আলো আসছে। আঙ্কেল আমার কথা শুনবেন, বুঝিয়ে বললে রাগ করবেন না।
আর যা-ই হোক, ঘোড়ার পিঠে ওটাকে কিন্তু দারুণ মানিয়েছে,
তা-ই না, জিনা?
জিনা জবাব দিল কি না খেয়াল করল না কিশোর।
ওর মাথায় শুধু একটাই চিন্তা ঘুরপাক খেল–বর্মের ভিতর আলো। এল কোত্থেকে?
বর্মটার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে এখন কিশোর।
যতদূর সম্ভব হাত বাড়াল সামনে। ঘোড়ার পিঠের নাগাল পাওয়া গেল না। নেজার ঘোড়ার পিঠে চেপে আছে, আর ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে আছে চৌকো একটা প্ল্যাটফর্মের উপর।
নিজেকে এই মুহূর্তে বড় বেশি ছোট মনে হলো কিশোরের।
এখন?
এই দেখো! হঠাৎ করে মাথায় বুদ্ধি খেলে যেতে আপনমনে বলে উঠল ও। হাঁদা হয়ে গেছি আমি! এই জিনিস হাতের কাছে থাকতে আমি কিনা চিন্তা করছি!
মই ধরে বেয়ে উপরে উঠতে লাগল কিশোর।
কিশোর, বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু! নীচ থেকে ফিসফিস। করল জিনা। চলো, ফিরে যাই।
পাত্তা দিল না গোয়েন্দা-প্রধান।
কোনও কিছুকেই পাত্তা দিল না।
শুধু ওর ভিতরের শিরশিরে অনুভূতিটাকে ছাড়া।
মইয়ের ধাপ বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে কিশোর খেয়াল করল হাত দুটো ওর মস্তিষ্কের নির্দেশ মানতে চাইছে না বিচ্ছিরি ভাবে কাঁপছে।
কোনওমতে মইয়ের মাথায় উঠে এল ও। বর্মটাকে এখন পরিষ্কার দেখতে পেল।
শ্বাস-প্রশ্বাস অনিয়মিত হয়ে এল ওর।
বর্মটার ব্রেস্ট-প্লেট আর হেলমেটের সূক্ষ্ম কারুকাজ খুঁটিয়ে দেখল ও। ওটার কয়েক জায়গা তুবড়ে গেছে। বুঝতে বাকি রইল না নেজার ম্যাণ্ডার আর যা-ই হোক, দুর্দান্ত যোদ্ধা ছিল।
মুখের আবরণটার দিকে তাকাল ও। এই অংশটা খুলে বর্মধারী। যোদ্ধারা খাওয়া-দাওয়া করত, কথা বলত।
সামনে ঝুঁকল কিশোর। ওটার উপরের সরু ফাঁক দুটোর একটা দিয়ে বর্মের ভিতরটা দেখার চেষ্টা করল। এই ফাঁক দুটো চোখের জায়গায়, ওখান দিয়ে যোদ্ধারা দেখত।
ভিতরটা অন্ধকার।
কিছুই চোখে পড়ল না।
বাঁ হাতে মই আঁকড়ে ধরে ডানহাতে হেলমেটটা ছুঁয়ে দেখল ও।
ভিতরের শিরশিরানি বেড়ে গেল। তবে তা বাইরে প্রকাশ করল কিশোর।
দেখলে তো, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, নীচে তাকিয়ে জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করল ও।