এক ধাক্কায় কিশোরকে রাস্তার কিনারে ফেলে দিয়ে নিজেও ঝাঁপ দিয়ে পড়ল মুসা। পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া ট্রাকটার গরম বাতাসের ধাক্কা লাগল গায়ে। দেখতে দেখতে ট্রাকটা মোড় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল রাস্তার অন্য পাশে।
বড় বেশি তাড়াহুড়া মনে হচ্ছে, উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল কিশোর।
গা থেকে বালি, ঝাড়তে ঝাড়তে মুসা জিজ্ঞেস করল, ড্রাইভারের চেহারা দেখেছ?
না। দেখার সুযোগ পেলাম কোথায়? কাল রাতে যে গাড়িটা পিছু নিয়েছিল। আমাদের, ওইটা, তাই না?
তাই তো মনে হলো, মুসা বলল। তবে এবারও লাইসেন্স প্লেটটা দেখতে পারিনি। এমন করে ধুলোর ঝড় তুলে ছুটে গেল।
গাড়িটার ভাবনা আপাতত মাথা থেকে দূর করে দিল কিশোর। ইভা জানিয়েছে, সে আর জিনা এদিকের সৈকতে এলে পানির কিনারে একটা পামের জটলার কাছে বসে গায়ে রোদ লাগাত। কোথায় আছে সে-রকম জায়গা, খুঁজতে শুরু করল তার চোখ।
কিছুটা দূরে সৈকত ঘেঁষে একটা লাল রঙের বাড়ি দেখতে পেল। সামনে সবুজ লন। ওটাই সম্ভবত ডগলাস কেইনের বাড়ি।
শিস দিয়ে ফেলল মুসা। খাইছে! বাড়ি একখান!
দোতলা মূল বাড়িটা ছাড়াও একটা গেস্ট হাউস, পাঁচটা গাড়ি রাখার গ্যারেজ, আর অনেকগুলো কুকুরের ঘর আছে। গ্যারেজের পাশে দাঁড়ানো একটা কালো সিডান গাড়ি। খানিক দূরে কংক্রীটের প্যাডের ওপর রাখা একটা ছোট হেলিকপ্টার।
সাংঘাতিক ধনী তো লোকটা, কিশোর বলল।
সে তো বটেই, মুসা বলল। কুপাররা বলল না, যা কিনতে ইচ্ছে হয়, কেনার ক্ষমতা আছে ডগলাস কেইনের।
নিচু একটা দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। সর্বসাধারণের জায়গা থেকে বাড়ির সীমানা ভাগ করা হয়েছে ওই দেয়াল দিয়ে। দেয়ালের দুই প্রান্ত থেকে ছোট ছোট খুঁটির সারি চলে গেছে সৈকতের ওপর দিয়ে পানির কাছে। খুঁটিগুলোতে শিকল লাগিয়ে বেড়া বানিয়ে আলাদা করে দেয়া হয়েছে সৈকতটা। শিকলের ভেতরটা ব্যক্তিগত বুঝিয়ে দিয়েছে।
কি ভাবছ? ভুরু নাচাল মুসা। চলে যাব নাকি ওপাশে?
আমি তো জানতাম, সৈকতের কোন মালিক থাকে না। তা ছাড়া ভেতরে ঢাকা বেআইনী কথাটা যখন কোথাও লেখা নেই, মুচকি হাসল কিশোর, ঢুকে পড়লামই বা।
সহজেই বেড়াটা ডিঙিয়ে চলে গেল মুসা। তার পেছনে রইল কিশোর। লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে যেতে লাগল ডগলাসের সৈকত ধরে। দেয়ালের গায়ে গেট দেখে ভেতরে ঢোকার জন্যে মোড় নিল।
যদি দেখে? মুসার প্রশ্ন।
কি আর করবে? কিশোর বলল আবার। বড়জোর তার সীমানা থেকে বেরিয়ে যেতে বলবে…
কথা শেষ না করেই থমকে দাঁড়াল সে। কুকুরের ডাক কানে এসেছে। কোন দিক থেকে এল?
জানার জন্যে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। বাড়ির সীমানায় পা দিতে না দিতেই দেখে মূল বিল্ডিংটার পাশ ঘুরে ছুটে বেরিয়ে আসছে তিনটা কুকুর। ভয়ঙ্কর ডোবারম্যান পিনশার। বিকট ভঙ্গিতে দাঁত বের করে গর্জন করছে চাপা স্বরে।
কিশোর! চিৎকার করে উঠল মুসা।
লন মাড়িয়ে ছুটে আসছে কুকুরগুলো। সামনের কুকুরটা, বিরাট একটা কালচে-বাদামী জানোয়ার সোজা ধেয়ে আসছে কিশোরের দিকে।
.
০৫.
কিশোর, জলদি! বলে এক চিৎকার দিয়েই ঘুরে ছুটতে শুরু করল মুসা। লাফ দিয়ে গিয়ে উঠে পড়ল নিচু দেয়ালটায়। কিশোর কি করছে দেখার জন্যে ফিরে তাকাল।
প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে কিশোর। কুকুরগুলোকে পেছনে ফেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। পায়ের কাছে খটাস খটাস চোয়াল বন্ধ করছে সামনের কুকুরটা। যে কোন মুহূর্তে কামড় লেগে যাবে।
কিশোরও দেয়ালটার কাছে পৌঁছে গেল। লাফ দিয়ে উঠে পড়ল দেয়ালে। উঠতে সাহায্য করল তাকে মুসা। এক মুহূর্ত দেরি না করে লাফ দিয়ে উল্টো দিকের সৈকতে নেমে পড়ল দুজনে। বালি মাড়িয়ে ছুটতে লাগল।
কয়েক সেকেন্ড পরেই সৈকতে বেরোনোর গেট দিয়ে বেরিয়ে এল কুকুরগুলো। পেছন পেছন আসতে লাগল।
উপায় না দেখে আবার দেয়াল ডিঙিয়ে বাড়ির সীমানায় ঢুকে পড়ল ওরা। দেয়ালে বসে থাকা নিরাপদ নয়। নিচু। লাফ দিয়ে ধরে ফেলতে পারবে কুকুরগুলো। বাঁচতে হলে কোন ঘরেটরে ঢুকে পড়তে হবে।
লন ধরে ছুটতে ছুটতে চোখের কোণ দিয়ে বাদামী একটা ছায়া দেখতে পেল কিশোর। কাছে এসে গেছে সামনের কুকুরটা।
ঘুরে দাঁড়াল মুসা। বুঝে গেছে দৌড়ে পরাজিত করতে পারবে না ওই ভয়ানক জানোয়ারগুলোকে। অ্যালুমিনিয়ামে তৈরি একটা লন চেয়ার তুলে নিয়ে বাড়ি মারার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল।
অ্যাই, থাম! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আদেশ শোনা গেল।
চোখের পলকে দাঁড়িয়ে গেল কুকুরগুলো। একেবারে কাঁচুমাচু হয়ে তাকাল মনিবের দিকে। স্লাইডিং ডোর সরিয়ে বেরিয়ে এসেছে লম্বা একজন লোক।
রোদে বেরিয়ে এল নোকটা। ভুরু কুঁচকে রেখেছে। গোয়েন্দারা তার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই হাসল। কিন্তু চোখের শীতলতা কাটল না তাতে।
দারুণ জিনিস পুষছেন, শুকনো কণ্ঠে বলল কিশোর।
ঠিকই বলেছ, লোকটা জবাব দিল। তোমাদের আগে যে লোকটা কাউকে কিছু না বলে বাড়িতে ঢুকেছিল, কামড়ে তাকে মেরেই ফেলেছিল আরেকটু হলে।
আমাকে কিছু করার আগে আমি ওর ঘাড়টা ভেঙে দিতাম, হাতের চেয়ারটা মাটিতে ফেলে দিল মুসা।
ডগলাস কেইন, মুসার কথা যেন শুনতেই পায়নি, এমন ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দিল লোকটা।
কিশোর পাশা, কেইনের হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিল কিশোর। ও আমার বন্ধু, মুসা আমান।