ঘোলাটে লাল একটা গোল রিঙ সৃষ্টি করে জ্বলছে টর্চটা। তবে দরজাটা কোথায় আছে দেখার জন্যে যথেষ্ট।
সেদিকে তাকিয়ে ডাক দিল, মুসা! বেরিয়ে এসো জলদি!
সাড়া পেল না।
মুসা!
এই যে! দরজার কাছ থেকে শোনা গেল তার ফ্যাসফেসে কণ্ঠ।
জিনার শক্তি প্রায় শেষ। তাকে ধরে ধরে নিয়ে আসছে মুসা।
বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে।
তাবুর দরজাটা কোন দিকে আছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মুসাদেরকে আসতে বলে আন্দাজে সেদিকে দৌড় দিল কিশোর।
দরজাটা পাও গেল না। কিন্তু তাবুর দেয়াল ঠেকল হাতে। মরচে পড়া ছুরিটা চালাল পাগলের মত। ধার বলতে নেই। তবু চোখা মাথাটা কাজে লাগল।
যেন দুঃস্বপ্নের ঘোরে ছুরির খোঁচা মারতে মারতে ফেঁড়ে ফেলল ক্যানভাসের খানিকটা জায়গা। পেছনে তাকিয়ে ডাক দিল, মুসা!
এই যে আমি!
ঠিক এই সময় নিভে গেল টর্চ।
কাজ প্রায় শেষ। আর দরকারও নেই এটার। তবে টর্চটার প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেছে কিশোরের মন। তাই ফেলতে পারল না। ভরে রাখল পকেটে।
বাইরে বেরিয়ে এল সে। তাঁবুর কাছেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাটিতে। মুখ হাঁ করে ডাঙায় ভোলা মাছের মত খাবি খেতে খেতে বাতাস টানতে লাগল।
ফুসফুস ভরে গেল সাগর থেকে আসা তাজা হাওয়ায়।
কমে আসতে লাগল জ্বলুনি। বুকের চাপ। মাথাটা পরিষ্কার হয়ে আসছে।
পেছনে গোঙানির মত আওয়াজ শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখল মুসা আর জিনাও তার মত মাটিতে পড়ে বাতাস টানছে।
পুরো এক মিনিট পর কথা বলল জিনা, উহ, নরক থেকে বেঁচে এলাম!
তাহলেই বোঝো, পোকামাকড়ের কত কষ্ট! শুকনো হাসি হাসল মুসা। ওদেরকে যে কত ভাবে মারি আমরা!
জ্বালায় বলেই তো মারি, জিনা বলল।
আমাদের কাছে জ্বালানো মনে হয়। আসলে তো ওরা বাঁচতে চায়, খাবার খেতে চায়। আমাদের যন্ত্রণা দেয়ার জন্যে মোটেও করে না।
উঠে বসল কিশোর। কথা বোলো না। কাছাকাছিই থাকতে পারে ওরা। কথা শুনলে আবার এসে ধরবে। এবার এমন ব্যবস্থা করবে, যাতে কোনমতেই আর বাঁচতে না পারি।
হামাগুড়ি দিয়ে বনের দিকে এগোল ওরা। উঠে দাঁড়ালে যদি চোখে পড়ে যায় এই ভয়ে।
গাছপালার ভেতরে এসে উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে শুরু করল বন থেকে বেরোনোর জন্যে।
বনের বাইরে বেরোতেই একটা গাড়ি চোখে পড়ল। হলুদ রঙের একটা সিডান। গায়ে বড় একটা পোকার ছবি। নিচে কোম্পানির নাম লেখা।
ভেতরে কেউ নেই, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর কাছে এল ওরা। নামটা পড়ে বুঝে গেল কিশোর, গাড়িটা এখানে কেন। কয়েকটা প্রশ্নেরও জবাব পেয়ে গেল। বলল, পোকা-মারা কোম্পানির গাড়ি। পেশাদার লোককে নিয়ে এসেছে ওরা। নিয়মিত বোধহয় পোকা মেরে রেখে যায় লোকটা। আমাদের তাঁবুর ভেতরে ভরে মারার কারণটা বুঝেছ?
না, মাথা নাড়ল মুসা।
অ্যাক্সিডেন্ট হিসেবে দেখানোর জন্যে। বলবে, ভুলক্রমে দুর্ঘটনায় মারা গেছি আমরা।
এত ঝামেলা না করে হাঙর কিংবা অ্যালিগেটরের পুলে ফেলে দিলেই কি ভাল করত না? চিহ্নও থাকত না আমাদের।
ওরকম কিছু করলেই বরং পুলিশের সন্দেহ বাড়ত। ওরা জানে, আমরা উধাও হয়ে গেলে সেটা নিয়ে তদন্ত হবে। আমাদের বাড়ি থেকে লোক আসবে। ডেপুটি গেকোর কথার দুই পয়সা দাম দেবে না। কারণ ঘুষখোর পুলিশটার সব কথা বলে দেবে রবিন। মিয়ামি পুলিশ যাবে তখন গাল আইল্যান্ডে। সূত্র ধরে ধরে গিয়ে হাজির হবে কেইনের বাড়িতে। সহজে ছাড়া হবে না তাকে। কোনখানে তার কয়টা বাড়ি আছে বের করে ফেলবে পুলিশ। এ বাড়িটাতে আসবে। হাঙর আর অ্যালিগেটরের পুল দেখলে বুঝে যাবে আমাদের কি গতি করেছে কেইন।
গ্যাসের মধ্যে পড়ে মরলেও তো বুঝত।
না, অন্য কথা বোঝাতে পারত তখন কেইন। বলত জিনার খোঁজে আমরা গিয়ে তার তাঁবুতে ঢুকেছি। ঠিক এ সময় পোকা মারার জন্যে গ্যাস ছেড়েছে পোকা-মারা কোম্পানির লোক। আমরা যে ভেতরে আছি, জানার কথা নয় লোকটার। পুলিশকে বিশ্বাস করিয়ে ফেলত কেইন। তিন-তিনটা খুন করেও তখন ধোয়া তুলসি পাতা হয়ে থাকত সে।
কত্তবড় শয়তান! দাঁতে দাঁত চাপল মুসা। ওকে ধরে একবার হাঙর, একবার অ্যালিগেটরের পুলে যদি চুবাতে পারতাম, রাগটা কমত!
রাগ পরে কমিয়ো, হাসল কিশোর। এখন দেখো, গাড়িটা স্টার্ট দিতে পারো নাকি। হাতের কাছে যখন পেয়েই গেছি, পালানোর জন্যে রেডি থাকি।
দরজায় তালা দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি পোকা-মারা কোম্পানির লোক। চাবিটাও ইগনিশনেই আছে। মোচড় দিতেই গুঞ্জন তুলল ইঞ্জিন। স্টার্ট নেবে।
হয়েছে, থামাও! মুসার পাশে উঠে বসল কিলোর। কার-টেলিফোনটা টেনে নিল। ফোন করল মিয়ামি পুলিশকে।
ফোন ধরল যে ডিউটি অফিসার, তার নাম ডিটেকটিভ ওয়ারেন। কোন ভূমিকার মধ্যে না গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করল কিশোর, রাগবি ডাগোকে ধরতে চান? স্মাগলার এবং গ্যাংলীডার?।
সঙ্গে সঙ্গে জড়তা চলে গেল অফিসারের কণ্ঠ থেকে। কে বলছেন?
আমার নাম কিশোর পাশা। ঠিকানা দিচ্ছি, ভাল করে বুঝে নিন। এখানে এলেই আমাকে দেখতে পাবেন। শুধু রাগবি না, পুরো দলটাকেই ধরতে পারবেন।
ঠিকানা জানা নেই কিশোরের, কিভাবে কিভাবে কোনখানে আসতে হবে বলে দিল ডিটেকটিভ ওয়ারেনকে। পেছনে খুট করে শব্দ হতেই তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দিল কিশোর। তার মনে হলো, আরও কিছু যেন বলতে চেয়েছিল ডিটেকটিভ ওয়ারেন। কিন্তু সে-সময় আর নেই।