ঘুটঘুটে অন্ধকার।
দেখি, ঘোরো তো, মুসা বলল। তোমার হাতের বাঁধনটা খুলতে পারি নাকি। নিজেরটা তো নিজে পারব না।
কে? মুসা নাকি? অন্ধকার থেকে ভেসে এল একটা কণ্ঠ।
জিনা! একসঙ্গে বলে উঠল কিশোর আর মুসা।
ঘরের এক প্রান্ত থেকে দৌড়ে আসার শব্দ হলো।
সত্যি! তোমরা! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না! দুজনকেই ছুঁয়ে দেখতে লাগল জিনা।
বিশ্বাস না হওয়ার কিছু নেই, কিশোর বলল। যে হারে সূত্র রেখে এসেছ, খুঁজে বের করতে বরং দেরিই করে ফেলেছি। আরও আগে বের করা উচিত ছিল।
আমাকে যে এখানে আটকে রেখেছে, কার্ডটা দেখে বুঝেছ, না?
বুঝলেও নিজে নিজে আসিনি। ওরাই আমাদের এখানে ধরে নিয়ে এসেছে। নাও, এখন বাধনগুলো খোলো তো আমাদের। সব কথা পরে শুনব। তা তুমি ভাল আছ তো?
এ অবস্থায় কি আর ভাল থাকা যায়, প্রথমে মুসার বাঁধনটা খুলতে শুরু করল জিনা। রোজ এসে একবার করে খাবার দিয়ে যায়। ফাস্ট ফুড। একই বার্গার আর ফ্রাই খেতে খেতে জিভ পচে গেছে আমার।
চাবির রিঙে ছোট্ট একটা টর্চ আছে জিনার। সেটা কিশোরের হাতে তুলে দিল। ব্যাটারি প্রায় শেষ। সারাক্ষণ জ্বালালে কিছুই থাকত না। অন্ধকারেই বসে থেকেছি। দিনের পর দিন এ ভাবে থাকাটা যে কি কষ্টের!
পরে শুনব, কিশোর বলল। এখন বেরোনোর চেষ্টা করা দরকার।
আমি অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। তোমরা পারো নাকি দেখো।
বন্ধ, জানে, তবু প্রথমে গিয়ে দরজায় ধাক্কা মেরে দেখল কিশোর।
তাড়াতাড়ি করা দরকার, মুসা বলল। গ্যাস ছেড়ে দিলে আর বেরোনো লাগবে না কোনদিন।
গ্যাস! বুঝতে পারল না জিনা।
তাকে বুঝিয়ে দিল মুসা। শুনে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না জিনা। আপনাআপনি হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেল যেন তার। বসে পড়ল মাটিতেই। বিষাক্ত গ্যাসের সাহায্যে কি করে গুদামে পোকা মারা হয়, জানে সে।
কিশোর কোন কথা বলছে না। কাজে ব্যস্ত। পেনলাইটের সামান্য আলো দিয়ে ছাতের একটা গ্রিল আবিষ্কার করে ফেলল।
ওদিক দিয়ে বাতাস আসে, মুসার দিকে ঘুরে তাকাল সে। মুসা, এসো তো এখানে। তোমার কাঁধে চড়ে দেখি কিছু করতে পারি কিনা।
গ্রিলটার নিচে এসে দাঁড়াল মুসা। তার কাঁধে চড়ল কিশোর। জিনা মুসাকে এমন করে ধরে রাখল, যাতে সে ঠিকমত দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, কিশোরের কাজে ব্যাঘাত না হয়।
জিনার কী-রিঙটা আলো ছাড়াও আরও নানা ভাবে সাহায্য করল। একটা চাবি দিয়ে গ্রিলের স্ক্রুগুলো খুলে ফেলল কিশোর। ঠেলা দিয়ে সরাতে গিয়ে বুঝল, কেবিনের ওপরও ভারী জিনিসপত্র রাখা হয়েছে। গ্রিলের কিনারে চেপে বসেছে ওগুলো।
রাজ্যের যত জিনিস চাপিয়ে দিয়েছে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সে। হাত ওপর দিকে তুলে রাখতে রাখতে পেশীতে ব্যথা শুরু হয়েছে।
পারছ না? ওপর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা। কিশোরের ভার বইতে বইতে সে-ও ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে।
সরাতেই হবে, কিশোর বলল। বেরোনোর এটাই একমাত্র পথ।
কিসের শব্দ! উদ্বিগ্ন শোনাল জিনার কণ্ঠ।
খবরদার, শ্বাস নেবে না! চিৎকার করে উঠল কিশোর। গ্যাস ছেড়ে দিয়েছে!
দুই হাতে প্রাণপণে গ্রিলটা ধরে ঠেলতে লাগল সে। তার চাপে বাঁকা হয়ে যাচ্ছে মুসা। কিন্তু সরল না।
নড়তে শুরু করল অবশেষে গ্রিলটা। শেষ বারের মত জোরে ঠেলা মেরে পাশে সরিয়ে দিল কিশোর। দুড়ম-দাড়ম করে কি সব যেন পড়ল কেবিনের ছাত থেকে গড়িয়ে।
গ্রিলের ফোকরের দুই প্রান্ত চেপে ধরে নিজেকে টেনে তুলতে শুরু করল সে। মাথাটা ঢুকিয়ে দিল ফোকরের ভেতর দিয়ে। ফোকর গলে উঠে এল ওপরে। ছাতে উঠে বসল।
দম বন্ধ করে রেখেছে।
হামাগুড়ি দিয়ে ছাতের কিনারে চলে এল সে। লাফ দিয়ে মাটিতে নামল।
দরজার ডাণ্ডাটায় তালা দেয়া না থাকলেই হয় এখন। তালা থাকলে খুলতে পারবে না। বের করে আনতে পারবে না মুসা আর জিনাকে।
কতক্ষণ আর দম আটকাবে? শ্বাস টানল। ভয়ানক বিষাক্ত, তীব্র ঝাজাল গ্যাস মেশানো, বাতাস ঢুকে গেল নাক দিয়ে। জ্বালা করে উঠল কণ্ঠনালী। ফুসফুসে চাপ অনুভব করল।
দৌড় দিল দরজাটার দিকে।
টর্চের সামান্য আলো ব্যবহার করে দেখল, তালা নেই।
দ্রুতহাতে ডাণ্ডাটা সরিয়ে খুলে ফেলল দরজা।
জিনা! মুসা! ডাক দিল সে।
হাঁসফাঁস করছে ওরা দুজনে। জিনার গোঙানি শোনা গেল। ফাঁসাসে কণ্ঠে মুসা কি বলল, বোঝা গেল না।
শ্বাস নিচ্ছ কেন? চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। জলদি বেরিয়ে এসো!
বলল বটে, কিন্তু সে নিজেই আর দম না টেনে থাকতে পারবে না। গলার মধ্যে ঘড়ঘড়ানি শুরু হয়ে গেছে। আগুন ধরে গেছে যেন ফুসফুসে। মাথার ভেতরটা ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। চিন্তার শক্তি হারাচ্ছে। কি করবে?
ইচ্ছে করছে মাটিতে শুয়ে পড়ে গভীর ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে।
.
১৪.
গ্যাসের শিকার হওয়া চলবে না এখন কোনমতে!
নিজেকে বোঝাল কিশোর।
কোন একটা অস্ত্রের জন্যে মরিয়া হয়ে তাকাতে লাগল চারপাশে। টর্চের আলো এত কমে গেছে যে, যে কোন মুহূর্তে নিভে যাবে। তার আগেই খুঁজে বের করতে হবে কিছু একটা।
কেবিনের সামান্য দূরে একটা বেঞ্চ দেখতে পেল। ওঅর্কবেঞ্চ। তাতে দুচারটা যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। শাবল, হাতুড়ি, এ সব।
কিন্তু আসল জিনিসটা কই?
যেটা খুঁজছে সে?
দেখতে পেল। দুলে উঠল বুকের মধ্যে। তাড়াতাড়ি ছুটে গেল।
থাবা দিয়ে তুলে নিল মরচে পড়া ছুরিটা।
দরজার কাছে ফিরে এল। বহু কষ্টে অজ্ঞান হওয়া থেকে বিরত রাখছে নিজেকে।