বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, দেখো তো, ওয়াইল্ড পাম মোটেলটার কথা লেখা আছে নাকি?
আছে, ট্রাভেল বুকের পাতা উল্টে দেখে বলল রবিন। দ্বীপের উত্তর প্রান্তে। বলছে প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব সুন্দর ওখানকার। থাকার জন্যে বিশটা আধুনিক কটেজ আছে, এয়ারকন্ডিশনার আর টিভি সহ। সৈকতের কাছে। মার্কেটিং সুবিধা আর নাইটলাইফ সহ।
এই নাইটলাইফটা কি জিনিস? মুসার প্রশ্ন।
বুঝতে পারছি না, জবাব দিল রবিন। গেলেই বোঝা যাবে। তবে রাতের বিনোদনের কথাই বলেছে হয়তো, সেটারই নাম দিয়েছে নাইটলাইফ।
.
পাক্কা তিরিশটা ঘণ্টা রাস্তায় কাটিয়ে অবশেষে সরু আইল্যান্ড কজওয়েতে গাড়ি ঢোকাল মুসা।
নাইটলাইফের তো কিছুই দেখছি না, চারপাশে তাকাতে তাকাতে বলল কিশোর।
ওই যে নাইটলাইফ, হাত তুলে সামনের বাড়িটা দেখাল মুসা। কুপারস ডিনার। এখনও খোলা।
কিশোর আর রবিন দুজনেই হাসল। তাকিয়ে আছে বাড়িটার দিকে। পুরানো ঢঙে তৈরি বাড়ি, সাদা রঙ করা। দ্বীপের মেইন স্ট্রীটের নাম কারলু রোড। এই রোডের পাশে কজওয়ের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা।
নাইটলাইফ বটে, বিড়বিড় করল কিশোর।
ওই যে, আমরা যেটা খুঁজছি, গাল আইল্যান্ড মেরিনার দিকে হাত তুলল রবিন। সাইনবোর্ডে লেখা: ওয়াইন্ড পাম মোটেল। চার মাইল।
মুসা, ডানে ঘোয়রা, বলল সে।
সাংঘাতিক ঝড় হয়ে গেছে এখানে, বিধ্বস্ত গাছপালাগুলো দেখে বলল মুসা। ভেঙে এসে রাস্তায় পড়ে আছে কিছু নারকেল আর পাম গাছ। সে-সব এড়িয়ে সাবধানে চালাতে হচ্ছে তাকে।
দিনের আলোয় নিশ্চয় অন্য রকম লাগবে, হতাশ মনে হলো রবিনকে। এখন তো একেবারে বিবর্ণ!
শুধু বিবর্ণই নয়, রুক্ষও লাগছে। রাস্তায় মানুষজন নেই। বাড়িঘরও তেমন দেখা যাচ্ছে না এদিকটাতে।
সত্যি কথা বলব? মুসা বলল। সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটাও দেখছি না আমি। বরং ভূতুড়ে মনে হচ্ছে। দেখলে মনে হয় কাজ করতে করতে কিসের আশঙ্কায় যেন হঠাৎ করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে উন্নয়ন। দেখছ না কেমন আধখাপচা তৈরি হয়ে পড়ে আছে বাড়িগুলো?
যা-ই বলো, কিশোর বলল, এতটা খারাপ কিন্তু না। আমি তো কার্ড তৈরি করার উপযোগী প্রচুর দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি।
কথাটা ভুল বলেনি সে। গাছপালার যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে ঝড়ে, কিন্তু এখনও প্রচুর গাছপালা দাঁড়িয়ে আছে–ছবির মত করে সাজানো, তার ওপাশে চাঁদের আলোয় ঝিকমিক করছে গালফ অভ মেসিকো।
যাক, এলাম শেষ পর্যন্ত, শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। পুরো আধপাক গাড়ি ঘুরিয়ে মোড় নিল। পাশ দিয়ে চলে গেল গোলাপী নিওন আলোয় লেখা ভ্যাকেন্সি সাইন। গাড়ি থামাল এনে ওয়াইল্ড পাম মোটেলের অফিসের সামনে।
ওয়াইল্ড পাম কেন নাম রাখা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে, হোটেলের সীমানার মধ্যে জন্মানো উঁচু উঁচু পামের জটলাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল রবিন। প্রচুর গাছ।
জেগেই আছে মনে হয়, আলোকিত অফিসের দিকে তাকিয়ে থেকে ইমার্জেন্সি ব্রেকটা লাগিয়ে দিল মুসা।
ঘড়ি দেখল কিশোর। হাত-পা টান টান করে দিয়ে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার আড়ষ্টতা কাটাতে চাইল। নামার সময় হয়েছে।
হঠাৎ এক ধাক্কায় তার পাশের দরজাটা খুলে ফেলে লাফ দিয়ে নেমে দিল দৌড় মুসা।
.
০২.
কিশোরও দরজা খুলে লাফিয়ে নেমে মুসার পেছনে ছুটল। অফিসের পেছনের ঘন ঝোঁপঝাড়গুলোর মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে মুসা।
মুসা! দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। ঝোঁপের অন্ধকারে মুসাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাল তার চোখ।
জবাব দিল না মুসা।
মুসা! আবার ডাকল সে।
আচমকা হুড়মুড় করে অন্ধকার থেকে উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় বেরিয়ে এল মুসা।
অফিসের পেছনে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারছিল একটা লোক, কোনখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল হাত তুলে দেখাল সে। আমাদের দেখে দৌড় মারল।
চেঁচামেচি শুনে অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন লম্বা এক ভদ্রলোক। বয়েস প্রায় ষাট। ছোট করে ছাটা ধূসর রঙের দাড়ি। অফিসের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। পেছনে বেরোল কিশোরদের বয়েসী এক কিশোরী।
হালো, ডেকে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক, এসেছ তাহলে। তোমাদের অপেক্ষাতেই ছিলাম।
হ্যাঁ, জবাব দিয়ে দ্রুত সেদিকে এগোল কিশোর। পেছনে এল মুসা।
আমি জেরাল্ড গ্লেজব্রুক, হাত বাড়িয়ে দিলেন ভদ্রলোক। ইভা তো তোমাদের দেরি দেখে অস্থির হয়ে যাচ্ছিল।
কতদিন পর দেখা! কেমন আছ তোমরা, কিশোর? এগিয়ে এল মেয়েটা। লম্বা, ছিপছিপে দেহ। সুন্দরী। লাল চুলগুলো মাথার পেছনে টেনে নিয়ে গিয়ে ঘোড়ার লেজের মত করে বেঁধেছে।
চাচা, ও কিশোর পাশা, পরিচয় করিয়ে দিল ইভা। আর ও মুসা, মুসা আমান …আর এই যে, রনি।
গাড়ি থেকে নেমে চলে এসেছে রবিনও। কিশোরের কাছ থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
খুব খুশি হলাম তোমাদের দেখে, আন্তরিক কণ্ঠে বললেন মিস্টার ব্রুক এই খানিক আগেও তোমার বাবা ফোন করে জিজ্ঞেস করেছেন তোমরা এসেছ নাকি, রবিনের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি। ইভা তো তোমাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তোমাদের মত গোয়েন্দা নাকি আর সারা দুনিয়ায় নেই।
বাড়িয়ে বলেছে, হাসল কিশোর। বন্ধু তো। প্রশংসা করা কথাবার্তা বিব্রত করে ওকে, তাই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার জন্যে বলল, যাই হোক, আপনাদের চমকে দিতে চাই না। তবু বলতেই হচ্ছে, আপনাদের পেছনের জানালায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছিল একটা লোক। আপনারা কোন শব্দটব্দ শুনেছেন? অস্বাভাবিক কিছু?