বাটিটা সামনে বাড়িয়ে দিল মুসা। তাতে কি? চেহারা স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
বাটিটা নিজের হাতে নিয়ে নিল টেরি। কিছুক্ষণ চুপচাপ চিবাল। অপেক্ষা করিয়ে রাখল মুসাকে। তারপর মুচকি হেসে বলল, নিনা আমাকে সব বলে দিয়েছে, মু-ম্মুসা। পোকা-মাকড় থেকে শুরু করে দুনিয়ার তাবৎ জিনিসকে ভয় পাও তুমি। ভয় পেলে তোতলাতে থাকো। নিজের ছায়া দেখলে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেল।
হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে মুসা।
নিনা আমাকে বলেছে, গত বছর দুপুরবেলা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলে। রাস্তায় মানুষ ছিল না। নিনা আর তার এক বান্ধবী বনের ভেতর থেকে নাকি স্বরে কথা শুরু করল। তুমি নাকি বেদিশা। পাশের খালে দিলে ঝাঁপ। সাতরে ওপারে উঠে প্রায় বেহুশ। এমন কাণ্ড করেছিলে, তুমি মরে গেছ। ভেবে ভড়কে গিয়ে নিনা আর তার বান্ধবী ঝেড়ে দিয়েছিল দৌড় বাড়ির দিকে।
মুখ কাচুমাচু করে কিছু বলতে যাচ্ছিল মুসা, তাকে থামিয়ে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠল কিশোর। মিথ্যে বলার আর জায়গা পেলে না! ভূতের ভয়ে পানিতে ঝাঁপ দেবে মুসা আমান? ভূতের ঘাড় মটকে দেবে। কতদিন অমাবস্যার রাতে ভূত খুঁজে বেড়িয়েছে ও। আর তুমিও যেমন, টেরি! তোমার মিথ্যুক বোনটা এসে কি না কি বানিয়ে বলল, আর তুমিও তার কথা বিশ্বাস করলে। অবশ্য তোমার আত্মীয় তো, ভাল আর কোত্থেকে হবে। কিংবা হয়তো নিনা কিছুই বলেনি, তুমি নিজেই বানিয়েছ। মুসাকে হিংসে করো তুমি। ওর মতো দুঃসাহসী তুমি আরও চোদ্দবার জন্মালেও হতে পারবে না।
কিশোরের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল টাকি। মুখে হাসি। তাই নাকি? তাহলে স্কুলে তোতলা মুসা খেতাব হয়ে গিয়েছিল কেন? মু-ম্মুসা বলে খেপাত কেন?
টা-টা-টা-ট্টাকির মত শয়তানগুলো সবখানেই আছে বলে।
তোমার সঙ্গে কথা বলছি নাকি? মুসার দিকে তাকাল টাকি। কেন খেপাত, বলো? নাকি এটাও মিথ্যে?
ঘেমে যাচ্ছে মুসা। গ্রীনহিলসে থাকতে শেষ দিকে সহপাঠীদের খেপানোর জ্বালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গিয়েছিল তার। ভেবেছিল, রকি বীচে এসে বাঁচল। কিন্তু অত্যাচারটা তো এখানে আরও বেশি হবে মনে হচ্ছে! বলতে গেল, আসলে একদিন একটা মা-মা-মা-মা-মা…
টাকির শয়তানি ভরা হাসিটা চওড়া হলো। কালো চোখের তারায় ঝিলিক। জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করল। কথা বের করতে পারছ না? আহারে! মোলায়েম কণ্ঠে বলল সে। ঠিক আছে, আপাতত তোমার তোতলামি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না আমরা। তুমি যে সাহসী সেটা প্রমাণ করে দাও।
হ্যাঁ, প্রমাণ করে দাও, এক সুরে কথা বলে উঠল টেরি। পপকর্নের খালি বাৰ্টিটা ঠাস করে টেবিলে রাখল সে। তুমি যে সাহসী সেটা প্রমাণের জন্যে একটা ছোট্ট পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছি আমরা।
জানালায় বিদ্যুতের আলোর ঝিলিক। ভয়ানক শব্দটা আসছে! অগ্রাহ্য করার জন্যে টেরিকে জিজ্ঞেস করল মুসা, পরীক্ষা? কিসের পরীক্ষা?
গুড়ম করে বিকট শব্দ হলো। নাক-মুখ কুঁচকে ফেলল সে। আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল চোখের পাতা। চোখ মেলে শুনল, কিশোর বলছে, কি পরীক্ষা?
কডির কাছে আছে, সহকারীর দিকে ফিরল টেরি। এনেছ না?
হ্যাঁ, ঘাড় কাত করল কডি। নিজে ভিজেছি, কিন্তু এগুলোকে ভিজতে দিইনি। জানি, কাজের জিনিস। এক ফোঁটা পানিও লাগেনি গায়ে। জ্যাকেটের নিচ থেকে লম্বা একটা কাঁচের বয়াম টেনে বের করল সে।
কি-কি-কি আছে ওর মধ্যে? নিজের অজান্তেই আবার তোতলানো শুরু করল মুসা।
বয়ামটা টেরির হাতে তুলে দিল কডি।
টেরি সেটা তুলে ধরল মুসার চোখের সামনে।
.
০৪.
মাকড়সা!
কালো, কুৎসিত, রোমশ অসংখ্য মাকড়সা কিলবিল করছে বয়ামটার মধ্যে। হেঁটে বেড়াচ্ছে বয়ামের দেয়ালে, একে অন্যের গায়ের ওপর।
মুসার নাকের কাছে বয়ামটা ঠেলে দিল টেরি। ঝাঁকি দিল বয়ামে। বয়ামের দেয়াল বেয়ে ওঠা মাকড়সাগুলো খসে পড়ল তলায়। প্রচণ্ড আক্রোশে খামচা-খামচি শুরু করে দিল।
মুসাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে টেরি, বুঝতে পারল কিশোর। থাবা দিয়ে টেরির হাত থেকে কেড়ে নিল বয়ামটা। মাকড়শাগুলো দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল, এত মাকড়সা জোগাড়ের কারণ? ভেজে খাও নাকি তোমরা?
খিকখিক করে হাসল টেরি। আমরা খাব কেন? তোমার দোস্তকে খাওয়াতে নিয়ে এলাম।
সাংঘাতিক রসিকতা করে ফেলেছে যেন টেরি। হাসাহাসি শুরু করে দিল তার দোস্তরা।
ভড়কে গেল মুসা। সর্বনাশ! সত্যি সত্যি খেতে বলবে নাকি!
ঘাবড়ে গেছে রবিনও। শুঁটকি-বাহিনীকে বিশ্বাস নেই। ওদের পক্ষে সব সম্ভব। মুসার জন্যে দুশ্চিন্তায় সাদা হয়ে গেল তার মুখ।
সেদিন বাজির কথা বললে না, কিশোরকে বলল টাকি। সেজন্যেই তো নিয়ে এলাম।
ভাল করেছ, আড়চোখে মুসার দিকে তাকাল কিশোর।
মুসার মুখ দেখে মনে হলো বেহুশ হয়ে যাবে। পোকা-মাকড়ের মধ্যে মাকড়সাকে সবচেয়ে বেশি ভয় তার। ভয়ঙ্কর-দর্শন প্রাণীগুলোর ওপর থেকে চোখ সরাতে পারছে না। একনাগাড়ে কামড়া-কামড়ি, খামচা-খামচি করে যাচ্ছে। অদ্ভুত ওগুলোর কুস্তি-যুদ্ধ।
তা কি করতে হবে মুসাকে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
কিছুই না, জবাব দিল টেরি। বয়ামের মধ্যে ওর হাতটা কেবল পাঁচটা মিনিট ঢুকিয়ে রাখতে হবে।
হাঁ হয়ে গেল মুসা। উঠে দৌড়ে পালানোর কথা ভাবতে লাগল। কানে এল কিশোরের কথা, কোন সমস্যা নেই। পাঁচ মিনিট কেন, পাঁচ ঘণ্টা বয়ামে হাত ঢুকিয়ে রাখতে পারবে মুসা। রবিনের দিকে তাকিয়ে সমর্থন চাইল, কি বলো, রবিন? মুসাকে আমরা চিনি।