রবিন যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই হাত তুলল টেরি, থামো, থামো…দাঁড়াও! কিশোরের দিকে তাকাল। গাল চুলকাল এক আঙুলে। তারমানে তোমার দোস্ত ভয় পায় না বলতে চাও?
হ্যাঁ, চাই। মনে মনে মুসার মুণ্ডপাত করছে কিশোর। প্রথম পরিচয়েই দিয়েছে নিজের দুর্বলতা টেরির কাছে ফাঁস করে।
টাকি বলল, প্রমাণ দিতে পারবে?
উত্তেজনায় টেরির গালের তিলগুলো যেন ঝিকমিক করে উঠল লাল কালো তারার মত। মুহূর্তে শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল ওর কুটিল মগজে। ঠিক, ঠিক, প্রমাণ! বাজি হয়ে যাক একটা!
বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ভেবে আবার থামাতে গেল মুসা, না না, প্লীজ…
তুমি থামো! মুসাকে কথাই বলতে দিল না কিশোর। তুমি এখানকার হালচাল কিছু জানো না। যা বলার আমি বলছি। টেরির দিকে তাকাল, কত টাকা?
টাকির দিকে তাকাল টেরি। দুজনের মুখেই কুটিল হাসি।
ঘড়ি দেখল টেরি। কিশোরের দিকে মুখ তুলল, তোমার যত ইচ্ছে। ভয় পেলে বাজিতে হারবে কালটু-আমান। টাকাটা কার পকেট থেকে দেবে সেটা তোমাদের মাথাব্যথা।…এই টাকি, চলো। স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
.
০৩.
দূর, টিভিতে কিছু নেই, বিরক্ত হয়ে রিমোটটা সোফার ওপর ছুঁড়ে ফেলল কিশোর। কম্পিউটার গেমগুলোও বিরক্তিকর! কি করা যায় বলো তো?
চুপ করে রইল মুসা আর রবিন। কি করলে ভাল লাগবে ওরাও বুঝতে পারছে না।
কিশোরদের লিভিং-রূমে বসে আড্ডা দিচ্ছে তিন গোয়েন্দা।
শনিবারের ধূসর এক বিকেল। ঘরের জানালায় একটানা আঘাত হেনে চলেছে বৃষ্টির ফোঁটা। পেছনের আঙিনায় পুরু হচ্ছে খসে পড়া পাতার আস্তর। প্রবল বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে গাছের ডালগুলো।
চিলেকোঠায় যাবে? জিজ্ঞেস করল কিশোর। জায়গাটা দারুণ। অন্ধকার। ছমছমে। যত দুনিয়ার বাক্স-পেটরা আর পুরানো জিনিসে বোঝাই। প্রচুর বইপত্র-ম্যাগাজিন। এক ধরনের উত্তেজনা আছে চিলেকোঠায়।
না রে, ভাই, আমি ওখানে যাব না, সাফ মানা করে দিল মুসা।
যে কোন অন্ধকার জায়গাকে তার ভয়। সেটা চিলেকোঠাই হোক আর পাতাল-ঘর। আলোকিত ঘরে থাকাটাই তার পছন্দ।
তাহলে আর কি করা! ভিডিওতে সিনেমা দেখি। উঠে ওপাশের দেয়াল ঘেঁষে রাখা আলমারিটার সামনে চলে গেল কিশোর।
প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল বাইরে। কেঁপে উঠল মুসা। ভয় ভয় লাগছে। তার। সাপকে ভয়, মাকড়সাকে ভয়, পোকা-মাকড়, ইঁদুর, অন্ধকার, ভূত, আরও অনেক কিছুকে ভয়। ইদানীং বজ্রপাতকেও ভয় পায়।
আলমারি থেকে কয়েকটা ভিডিও ক্যাসেট বের করে আনল কিশোর।
একটা ক্যাসেট হাতে নিয়ে ওপরে লাগানো ট্যাগটা পড়ল মুসা। সবগুলোই হরর ছবি নাকি?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর, হ্যাঁ।
তাহলে আমি দেখব না।
রবিনের দিকে তাকাল কিশোর, তুমি?
আমার আপত্তি নেই। কিন্তু মুসা যদি ভয় পায়….একজনকে সারাক্ষণ ভয়ের মধ্যে রেখে ছবি দেখে আমরাও মজা পাব না।
হতাশ হয়ে ক্যাসেটগুলো টেবিলের ওপর রেখে দিল কিশোর। মুসাকে নিয়ে এক বিরাট সমস্যা হয়েছে। এত ভয় পেলে কি করা! কোন রহস্যের সমাধান করতে গেলেও মনে হচ্ছে আর যোগ দিতে পারবে না মুসা। যা করতে দেয়া হবে তাকে, ভয়ে পিছিয়ে আসবে।
কি করবে ভাবছে, এই সময় চমকে দিল দরজার ঘণ্টা। বেজে উঠল টুং-টাং টুং-টাং করে।
চাচা-চাচী মার্কেট থেকে ফিরল নাকি? না, এত তাড়াতাড়ি তো ফেরার কথা নয়।
ফিরে তাকাল কিশোর।
আই, দরজা খোলো, মু-ম্মুসা! শোনা গেল একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠ। আমরা জানি, তুমি এখানে বসেই আড্ডা দিচ্ছ।
শুঁটকি টেরির গলা। চিনতে পারল তিনজনেই।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার। তাকে মু-ম্মুসা বলে ডেকেছে! শুঁটকি জানল কিভাবে?
কিশোরও অবাক। উঠে গেল দরজা খুলে দিতে।
ঘরে ঢুকল টেরি, টাকি এবং আরও তিনজন। হাত দিয়ে রেনকোট থেকে বৃষ্টির পানি ঝাড়তে লাগল টাকি। ভেজা জুতো নিয়েই উঠে আসতে গেল কর্পেটের ওপর। হাতটা বাড়িয়ে ঠেকিয়ে দিল কিশোর। বাড়ি বয়ে এসেছে, শত্রু হলেও অদ্ৰতা করল না। সৌজন্য দেখিয়ে ওদের ভেজা রেনকোট আর ম্যাকিনটশগুলো রেখে এল হ্যাঁঙারে। জুতোর তলা ভালমত মুছিয়ে নিল ডোরম্যাটে। কার্পেটে কাদা-পানি দেখলে কাউকেই আস্ত রাখতেন না মেরিচাচী। সবচেয়ে বেশি বকাটা খেতে কিশোর।
খোঁচা খোঁচা চুল থেকে আঙুল দিয়ে পানি ঝাড়ল টেরি। মুসার দিকে তাকিয়ে হাসল। মুসার মনে হলো, ইবলিসের হাসি।
মুসার হাতের পপকর্নের বাটি থেকে এক খাবলা পপকর্ন তুলে নিয়ে মুখে পুরল।
হাই, মু-ম্মুসা! ভুরু নাচাল লাল-চুল একটা ছেলে, ওর নাম কডি। তার সঙ্গী বাকি দুজন নিটু আর হ্যারল্ড ফ্যাকফ্যাক করে হাসল।
সব একই ক্লাসে পড়ে, মুসাদের ক্লাসে। হাসি, কথাবার্তা, আচরণে টেরির ফটোকপি একেকটা। সেজন্যেই দোস্ত হতে পেরেছে। টেরি ওদের নেতা হবার যথেষ্ট কারণ আছে। টেরির বাবার অনেক টাকা। টেরি হাত খরচ পায় প্রচুর। সেগুলো দুই হাতে খরচ করে বন্ধুদের পেছনে। নেতা হবার প্রধান কারণ সেটাই।
মু-ম্মুসা ডাক শুনে পেটের মধ্যে খামচে ধরল মুসার। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে চাইছে।
আ-আ-আমাকে এ রকম করে ডা-ডা-ডাকছ কেন? রাগ করে বলল মুসা।
যে-যে-যে রকম করে কথা বলছ, সে-সে-সে রকম করেই তো ডাকছি! খিকখিক করে হাসল টেরি। ভেবেছ জানি না? গ্রীনহিলসে যে স্কুলে পড়তে তুমি, সেটাতে পড়ে আমার কাজিন নিনা। আবার পপকর্ন নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল সে।