চিৎকার-চেঁচামেচি, স্বাগত জানানোর পালা চলছেই। কেউ থামতে চাইছে না।
মুখ বন্ধ রেখেছে মুসা। কপাল ব্যথা সত্ত্বেও মুখে হালকা একটা হাসি ফোঁটাতে বাধ্য হলো। সবাই এখন তাকে ছেড়ে সরে গেলে বাঁচে। স্বস্তিতে দম নিতে পারে।
কিন্তু আবার তাকে জড়িয়ে ধরলেন মহিলা। আরেকবার কতজ্ঞতা জানালেন। তারপর গাড়ির দিকে এগোলেন। বাচ্চাকে আবার পেছনের সীটে বসিয়ে সীট-বেল্ট আটকে দিতে লাগলেন।
কাঁধের ওপর আরেকটা হাত পড়ল। চাপ বাড়ল আঙুলগুলোর। কানের কাছে শুনতে পেল পরিচিত কণ্ঠস্বর, মুসা!
ফিরে তাকাল মুসা। হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর পাশা।
হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মুসা।
টেনে তাকে ভিড়ের ভেতর থেকে সরিয়ে নিয়ে চলল কিশোর। এদিক ওদিক তাকিয়ে ডাক দিল, রবিন, এসো তো এদিকে! ওকে ধরো! কিভাবে টলছে দেখো,। পড়ে যাবে।
গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসে ফিরে তাকালেন মহিলা। কিশোরর কথা কানে গেছে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তারের কাছে নেয়া লাগবে?
না না, লাগবে না! তাড়াতাড়ি জবাব দিল মুসা। বসলেই ঠিক হয়ে যাবে।
রাস্তার পাশে মুসাকে নিয়ে এল কিশোর আর রবিন।
সামনে এসে দাঁড়াল দুটো ছেলে। একজন ঢ্যাঙা, গায়ে মাংস বলতে নেই। মুখে প্রচুর তিল। পরনে নীল শার্ট, ফেড জিনস, দুই হাঁটুর কাছে ইচ্ছে করে ছিঁড়ে রাখা-স্মার্টনেস-যা দুচোখে দেখতে পারে না মুসা; ভিখিরি মানসিকতা মনে হয়। খোঁচা খোঁচা চুল। এক কান ফুটো করে তাতে একটা রূপার রিঙ পরেছে।
সঙ্গের ছেলেটা খাটো, মোটা, লম্বা লম্বা চুল। নাকের ওপর মস্ত এক আঁচিল। চোখের পাতা সরু সরু করে মুসাকে জিজ্ঞেস করল, হিরোগিরি দেখানোর নেশা আছে মনে হয় তোমার?
টেরা কথা শুনে চোখ গরম করে তাকাল মুসা, কে তুমি?
খিকখিক করে হাসল সঙ্গের ঢ্যাঙা ছেলেটা। হাসিটা শুনলে রাগ লাগে। সঙ্গীকে ধমক দিয়ে বলল, আই, টাকি, থামো তো তুমি! মুসার দিকে তাকাল, ও একটু বেশি কথা বলে। ওর কথায় কিছু মনে কোরো না। হাত বাড়িয়ে দিল, আমি টেরিয়ার ডুয়েল।
হাতটা ধরল মুসা। পাশে তাকিয়ে দেখল কিশোর আর রবিন গম্ভীর।
টেরির দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল কিশোর, কেন ওকে নিয়ে টানাটানি করছ, শুঁটকি দেখছ না ওর শরীর খারাপ লাগছে?
তুমি আবার এর মধ্যে কথা বলতে আসো কেন, টেটনা শার্লক? মুসাকে দেখিয়ে বলল, হিরোদের আমার পছন্দ। কারণ আমি নিজেও একজন হিরো তো। অবশ্যই ওকে আমার দলে নিয়ে নেব। মুসার দিকে তাকাল, আজই স্কুলে প্রথম যাচ্ছ, তাই না?
মাথা ঝাঁকাল মুসা।
হাসিমুখে টেরিকে বলল কিশোর, তোমার অবগতির জন্যে জানানো দরকার, শুঁটকি, মুসা আমান আমার অনেক পুরানো বন্ধু। গ্রীনহিলস থেকে এসেছে ও। বিশ্বাস না হলে রবিনকে জিজ্ঞেস করে দেখো।
রবিনের দিকে তাকাল টেরি।
মাথা ঝাঁকাল রবিন, হ্যাঁ।
মুখের আলো দপ করে নিভে গেল টেরির। হাসি উধাও। আঙুল ঢিল হয়ে গেল টেরির। খসে পড়ে গেল মুসার হাতটা। বড়ই হতাশ। ভেবেছিল, মুসার মত একজনকে দলে টেনে নিতে পারলে তার দলের সুনাম বাড়বে, শক্তিশালী হবে দল। কিন্তু টেটনা শার্লকটা যে আগেই ওকে বগলদাবা করে বসে আছে, কে জানত!
মুহূর্তে কিশোর আর রবিনের মত মুসাও টেরির শত্রু হয়ে গেল। চোখের পাতা সরু সরু করে মুসার দিকে তাকাল সে। বলল, হিরো না ছাই! মহিলাটা একটা ইয়ে। এমন সাহস নাকি আর জীবনে দেখেনি! আহা!
মুসাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল কিশোর, কেন, চোখের সামনেই তো দেখলে কি কাণ্ডটা করল! এরপরেও অবিশ্বাস? তোমার দলের সমস্ত ছুঁচোগুলোর সাহস এক করলেও মুসার সমান হবে না, তা জানো?
তাই নাকি? খিকখিক করে হাসল টেরি। ভাল জমবে মনে হচ্ছে। এবার!
চ্যালেঞ্জ করছ?
করছি।
সাহস নেই, সাফ বলে দিল টাকি।
অ্যাই, তুমি থামো, টাকিমাছ!
বাংলা শব্দটা বোঝে না টাকি। গর্জে উঠল, রোজই ট্যাকিমাছ ট্যাকিমাছ করো! পেয়েছ কি? কোন্দেশী গালি এটা? আজ তোমাকে বলতেই হবে! কি মানে এর?
গালি নয়, বাংলাদেশী একটা অতি লোভনীয় খাবারের নাম এটা, হেসে জানিয়ে দিল রবিন। টাকি হলো এক ধরনের মাছ, মরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে ভর্তা করে খেতে নাকি খুব টেস্ট। ঠিক আছে, বাংলা পছন্দ না হলে ইংরেজিতেই ডাকা হবে তোমাকে। ট্যাকি-ফিশ! কি, এবার ভাল লাগছে নামটা!
বিকৃত হয়ে গেল টাকির মুখ। দেখিয়ে ছাড়ব একদিন কে কাকে ভর্তা বানিয়ে খায় …
আহা, তোমরা এমন ঝগড়া শুরু করলে কেন… কথা শেষ না করেই বিকট এক চিৎকার দিয়ে উঠল মুসা। থাবা মারল পায়ে। সুড়সুড়ির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখল, লম্বা একটা ঘাসের ডগা লেগেছিল পায়ে। লজ্জা পেয়ে হাসল। আমি মনে করেছিলাম শুয়াপোকা…।
ভুরু কুঁচকে গেছে টেরির। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল মুসার দিকে। ধীরে ধীরে পাতলা হাসি ফুটল ঠোঁটে। কিশোরের দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, কই, ভয় নাকি পায় না?
এটাকে কি ভয় বলে?
তাহলে কি বলে?
চমকে যাওয়া, গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। পায়ে সুড়সুড় করলে তুমিও থাপ্পড় মারবে।
মারব, কিন্তু চিৎকার করব না।
দেখাব পায়ে লাগিয়ে? রবিন, ওই ফুল গাছটাতে দেখলাম কালো কালো শুয়াপোকায় ভরে গেছে। কিলবিল করছে। এত বড় বড় লোম। যাও তো, কাঠিতে করে নিয়ে এসো তো একটা।