মুরগির মত কঁক-কঁক করতে বলছ? মড়াগুলো ভয় পাবে তাতে?
আরে না না! কঁক-কঁক না! ওগুলোকে…
ও, জবাই করব! মুরগির মত?
পা-পা-প্পারলে তাই করো!
কিন্তু ছুরি কোথায়? অসহায় ভঙ্গিতে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা।
শু-শু-শুঁটকির কাছে… কথাটা আটকে গেল কিশোরের। বের আর করতে পারল না।
দুই হাত নাড়তে লাগল টেরি, ছু-ছু-ছুরি-টুরি কিছু নেই আ-আ-আ …
গেছে আজ! হতাশ ভঙ্গিতে কপাল চাপড়াল কিশোর। স-স-সব কটাকে তোতলা বানিয়ে দিয়েছে ভূ-ভূ-ভূ-ভূ… কোনমতেই বের করতে পারছে না শব্দটা। বের করার জন্যেই যেন জোরে এক ধাক্কা মারল মুসার পিঠে এবং হড়হড় করে স্পষ্ট কথা বেরিয়ে এল, দৈত্যগুলোকে ঠেকাও! বাঁচাও আমাদের!
ধাক্কা খেয়ে সামনে গিয়ে পড়ল মুসা।
একটা লাশ ওকে ধরে না ফেললে হুমড়ি খেয়ে পড়ত মেঝেতে। পচা, মাংস খসা বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরল ওকে লাশটা।
.
১৮.
ছাড়ো! ছাড়ো আমাকে! গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল মুসা, ভয় নয়, হুমকি। কেঁচোর মত শরীর মোচড়াচ্ছে, ছটফট করছে, আ য লাশের বাহু থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে। নইলে ভূতগিরি। ঘুচিয়ে দেব আজ জন্মের মত!
কিন্তু চোখ বোজা, সবুজ দানবটা ছাড়ল না ওকে। ঝাড়া লাগতে জট পাকানো চুলের বোঝা থেকে ঝরঝর করে ঝরে পড়তে লাগল মাছির সাদা সাদা শুয়াপোকা। পচা মুখটা নিয়ে এল চোখের সামনে। বাহুর চাপ আরও বেড়েছে। চাপ দিয়ে ভর্তা করে দেবে যেন হাড়-পাজরা।
হুটোপুটি শোনা গেল পেছনে।
কোনমতে ঘাড় ঘুরিয়ে মুসা দেখল, সামান্য সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার করেছে টেরিরা, পড়িমড়ি করে জানালার দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। মজা দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকার কথা কল্পনায়ও আনছে না আর ওরা।
সবার আগে জানালার কাছে পৌঁছল কডি। মুহূর্তে উড়ে চলে গেল যেন বাইরে।
মুসার কোমর জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করতে লাগল সবুজ মড়াটা।
সেসব দেখার সময় নেই নিটু আর হারল্ডের। কার আগে কে জানালা টপকাবে এই নিয়ে হুড়াহুড়ি শুরু করল। ধাক্কা দিয়ে দুজনকে দুই পাশে ফেলে বেরোনোর চেষ্টা করল কিশোর। তাতে গেল সব জট পাকিয়ে, তিনজনের কেউ বেরোতে পারল না। মাথার ওপর দিয়ে ডাইভ দিল টাকি। কপাল ঠুকে গেল চৌকাঠে। ব্যথাটাকে পাত্তাই দিল না সে। ডিগবাজি খেয়ে গিয়ে পড়ল, জানালার বাইরে। ফাঁক পেয়ে তার পর পরই বেরিয়ে গেল টেরি। ওর ঠ্যাং ধরে বেয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিল কিশোর। পারল না। পড়ে গেল মেঝেতে। টেরির পর একে একে বেরোল নিটু আর হ্যারল্ড।
হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। জানালায় উঠে বসল। চিৎকার করে ডাকতে লাগল, টেরি! টাকি! কডি! তোমাদের ঈশ্বরের দোহাই লাগে! আমাকে নিয়ে যাও। ফেলে পালিও না…
কিন্তু কেউ তার কথার জবাব দিল না। কাদা-পানিতে জুতো ফেলার ছপছপ শব্দ শোনা যাচ্ছে কেবল।
লাফিয়ে অন্যপাশে নেমে গেল কিশোর। তার জুতোর শব্দও মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে।
চুপ হয়ে গেছে মুসা। তাকে নড়তে-চড়তে না দেখে সবুজ মড়াটাও শান্ত হয়ে গেছে। চাপ দিচ্ছে না আর। ঝটকা দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে পিছিয়ে এল মুসা।
দৌড়ে এল জানালার কাছে। মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিল জানালার বাইরে।
আবছা অন্ধকারে অনেকগুলো ছায়ামূর্তিকে ছুটে যেতে দেখল পাতাবাহারের বেড়ার দিকে।
মড়াগুলোর দিকে ফিরল আবার মুসা। মুচকি হাসি ফুটেছে মুখে। সবুজ মড়াটাকে উদ্দেশ্য করে বলল, পালিয়েছে সব। চলো, এই সুযোগে কেটে পড়া যাক।
টান দিয়ে মুখ থেকে মুখোশটা খুলে নিল সবুজ মড়া। বেরিয়ে পড়ল রবিনের হাসিমুখ। কিশোর কোথায়?
ভঙ্গি দেখে যে কেউ ভাববে ভূতের তাড়া খেয়ে পালিয়েছে, হাসতে হাসতে বলল মুসা। ওর কাণ্ড দেখেই আরও ভড়কে গেছে শুঁটকি-বাহিনী।
কাণ্ড তুমিও কম করনি। উহ্, দুজনে মিলে যা শুরু করলে, হাসি চেপে রাখাই কঠিন হয়ে গিয়েছিল আমার জন্যে!
তোমাদের অভিনয় আরও ভাল হয়েছে, মেঝেতে চোখ পড়ল মুসার। মাছির পোকাগুলোর দিকে। অনড় পড়ে আছে। আজকাল প্ল্যাস্টিক দিয়ে কত রকমের জিনিস যে তৈরি করছে খেলনাওলারা। মুখ তুলল। দারুণ হয়েছে। ছদ্মবেশ। কারও বাপেরও চেনার সাধ্য ছিল না। …সত্যি সত্যি ভূত ভেবে আরেকটু হলে আমিও পালাচ্ছিলাম!
*
আধঘন্টা পর।
স্যালভিজ ইয়ার্ডে তিন গোয়েন্দার ব্যক্তিগত ওঅর্কশপে গাদাগাদি করে বসেছে ওরা সাতজন। কিশোর, মুসা, রবিন, তাদের দুই বন্ধু টম ও বিড, এবং ওদের দুজনের বন্ধু বারটি আর ডিউক।
হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গেছে ওদের। তা-ও থামছে না হাসি। হসির দমকে কয়েকবার করে পানি এসেছে চোখের কোণে। মুছেছে, আবার হেসেছে।
ও, হাসতে হাসতেই কাহিল হয়ে গেছি! মুসা বলল। কিশোর, আর সহ্য করতে পারছি না। ফ্রিজে কিছু নেই তোমাদের?
বসো। নিয়ে আসছি।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোট চারেক পিৎসা আর বড় এক জগ। কমলার রস নিয়ে হাজির হলো কিশোর।
খাবারের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সবাই। খিদে পেয়েছে সবারই।
খেতে খেতে মুসা বলল, কিশোরের প্ল্যানটা যে এ ভাবে কাজে দেবে, ভাবতে পারিনি। সত্যি বলতে কি, শুরুতে তো রাগই হচ্ছিল আমার ওর ওপর, টেরির দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শত্রুতা করছে ভেবে।
আর এখন? হেসে জিজ্ঞেস করল রবিন।
সেটা কি বুঝিয়ে বলতে হবে?
না, তা হবে না। তোমার রাগ হয়েছে, তাতে আর দোষ কি, ওর আচরণে আমিই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি, তোমার ভয়ের রোগটা সারানোর জন্যেই এই চালাকি করেছিল সে…