নিশ্চিত হলো মুসা, আজ আর কোন চালাকির মধ্যে যায়নি টেরির দল। তাহলে ঘাবড়াত না। সত্যিকার লাশের সঙ্গেই মুসাকে কোলাকুলি করতে নিয়ে এসেছে ওরা।
আবার শব্দ।
অন্য কফিনগুলোর দিকে তাকাল মুসা।
একটা কফিনের ডালা নড়ে উঠতে দেখল। আরেকটা। তারপর আরেকটা।
ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে কফিনগুলোর ডালা।
.
১৭.
রক্ত পানি করা চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে সরে এল মুসা। টলতে টলতে ও সরে গেল দেয়ালের দিকে।
কফিনের সারির দিকে তাকাল। ডালা ঠেলে তোলা হাতগুলো দেখতে পাচ্ছে। পচে ফুলে ওঠা সবজে-লাল হাত। দুর্ঘটনায় ডলা লেগে বিকৃত হয়ে যাওয়া বেগুনি হাত। মোমের মত সাদা ফ্যাকাশে হাত।
আ-আ-আমরা বি-বি-ব্বিরক্ত করেছি ওদের, ভালমত তোতলাতে শুরু করল মুসা। মি-মি-মৃত মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছি। প-প প্রতিশোধ নিতে আ-আ-আসছে।
একটা কফিনের ডালা পুরোপুরি উঠে গেছে। কুৎসিত, খসখসে গোঙানি শোনা গেল ওটার ভেতর থেকে। একটা মড়া উঠে বসল। পুরানো হতে হতে সবুজ হয়ে গেছে চামড়া। পচা-গলা মাথাটা ঘুরিয়ে তাকাল টেরির দিকে। চোখ খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেলাই করে পাতা দুটো লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল বলে খুলতে পারছে না।
গোঙানি, উহ্-আহ্, জোরাল গভীর দীর্ঘশ্বাস-নানা রকম ভয়ঙ্কর শব্দে ভরে গেল ঘরের বাতাস।
অন্য একটা কফিন থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল আরেকটা মড়া। পচে, ফুলে বীভৎস হয়ে গেছে মুখটা। রক্তশূন্য চামড়ার রঙ মোমের মত। লাশ তো, তাই স্বাভাবিক মানুষের মত ক্ষিপ্রতা নেই বোধহয় গায়ে, ধীরে সুস্থে, বেশ ভারী পায়ে নামছে।
তৃতীয় লাশটাও উঠে বসেছে এখন। বেগুনী লাশ। নাকের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসা সাদা সাদা কৃমিগুলোকে ঝুলতে দেখে পেট গুলিয়ে উঠল মুসার।
বিকট চিৎকার বেরিয়ে এল টেরির মুখ থেকে।
অ-অ-অসম্ভব! কডি বলল। এ হতেই পারে না!
মড়াদের বিরক্ত করেছি আমরা! আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল কিশোর। ওদের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছি। ওরা আমাদের ছাড়বে না …
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল একটা কাঠের আলমারির দরজা। দড়াম করে গিয়ে পাল্লাটা বাড়ি খেল শক্ত দেয়ালে।
পা টেনে টেনে বেরিয়ে এল একটা ভয়ঙ্কর-দর্শন লাশ। নিশিতে পাওয়া মানুষের মত ঘোরের মধ্যে হাঁটছে। ওটার চোখের পাতাও সেলাই করে লাগানো। খুলতে পারছে না। মাথার চামড়া অর্ধেক ছিলে এসে ঝুলে রয়েছে কপালে। সামনে দুই হাত বাড়িয়ে থপ থপ করে পা ফেলে এগোতে লাগল ধরার জন্যে।
চিৎকার করে উঠল মুসা।
চিৎকার করে উঠল কিশোর।
টেরি আর টাকি সরে চলে এল মুসার কাছে।
আরেকটা রক্ত জমানো গোঙানি শোনা গেল। ফিরে তাকাল সবাই। আরও একটা লাশ বেরিয়ে এসেছে। মাথায় চওড়া কানাওয়ালা হ্যাট। গায়ে ঢলঢলে একটা ট্রেঞ্চ কোট, নিজের আকারের চেয়ে অনেক বড়। টলতে টলতে এগিয়ে আসতে লাগল মুসাদের দিকে।
কুঁজো হয়ে এগোচ্ছে। লাশের চেহারা ঢেকে দিয়েছে হ্যাঁটের কানা। সামান্য মুখ তুলতেই যেটুকু অংশ চোখে পড়ল, তাতেই বুকের রক্ত পানি হয়ে যাওয়ার কথা অতি বড় সাহসীরও।
মুখের অর্ধেকটা আছে, বাকি অর্ধেকের মাংস গায়েব। খসে পড়ে গেছে। হাড়গুলো শুধু দেখা যাচ্ছে। শূন্য কোটর থেকে ঝুলছে একটা মরা ইঁদুর।
আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল কিশোর।
কুৎসিত গোঙানি। ঘড়ঘড়ানি। আর চাপা দীর্ঘশ্বাস। চলছে একটানা।
দুর্ঘটনায় মৃত লম্বা, বেগুনি রঙের থেঁতলানো, বিকৃত লাশটা নেতৃত্ব দিচ্ছে মড়াদের। মাথা নিচু করা, চোখ বোজা। অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাঁটছে। এক পা বাড়িয়ে দিচ্ছে সামনে, থমকাচ্ছে, তারপর আরেকটা পা ফেলছে।
থমকে দাঁড়াল হঠাৎ।
ঝুঁকি লেগে কাঁধ থেকে খসে পড়ে গেল একটা হাত। বিশ্রী শব্দ করে মেঝেতে পড়ল। লাফ দিয়ে চলে গেল একটা টেবিলের নিচে।
হাত খসে পড়াতে যেন কিছুই হয়নি লাশটার। পরোয়াই করল না। একটা সেকেন্ড বিরতি দিয়েই আবার আগের মত এগিয়ে আসতে শুরু করল।
জলদি পালাও! চিৎকার করে উঠল হ্যারল্ড। আতঙ্কে কুঁচকে গেছে চোখ-মুখ।
কিন্তু দেরি করে ফেলেছে।
জানালার দিকটাকে আড়াল করে অর্ধচন্দ্রাকারে সারি দিয়ে ওদের কোণঠাসা করে ফেলেছে লাশের দল।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সবার।
কফিনের লাশটার দিকে তাকাল মুসা। একমাত্র মড়া, যেটা একইভাবে পড়ে রয়েছে। কফিন থেকে উঠে আসেনি। আসার কোন লক্ষণও দেখাচ্ছে না।
ওটার দিকে নজর নেই কারও। তাকিয়ে আছে এগিয়ে আসতে থাকা লাশগুলোর দিকে। টেনে টেনে হাঁটার কারণে জুতো ঘষার খসখস শব্দ হচ্ছে মেঝেতে।
চিৎকার করে উঠল আবার কিশোর, মুসা, কিছু একটা করো!
আমাকে বলছ! কেঁপে উঠল মুসার গলা। আমি করব?
থামাও ওদের! চেঁচিয়ে উঠে মুসাকে সামনে ঠেলে দিল টেরি। মুসা …তুমিই পারবে! আমাদের মধ্যে একমাত্র তোমারই সাহস আছে!
আমার! বিশ্বাস করতে পারছে না যেন মুসা।
হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার! বাজিটা জিতে গেছ তুমি! সাইরেনের মত কাঁপা কাঁপা শব্দে নিঃশ্বাস বেরোচ্ছে টেরির নাক দিয়ে। এমন ভয় পাওয়াই পেয়েছে, এতটাই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে মুখের চামড়া, তিলগুলোও এখন অদৃশ্য। তুমি জিতে গেছ! তুমি জিতে গেছ! তুমি জিতে গেছ! তিনবার বললাম। তারমানে তোমার জেতা নিয়ে কারও সন্দেহ নেই আর। দোহাই তো-তো-তোমার, মুসা, ক-ক-করো কিছু… আতঙ্কে তোতলানোর সঙ্গে চন্দ্রবিন্দুও যোগ হয়ে গেছে টেরির উচ্চারণে।