জলদি ওঠো, মুসা!-নিজেকে তাগাদা দিল সে। বাচ্চাটাকে বাঁচাও!
লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল মুসা। ঢাল বেয়ে ছোটা কঠিন। রাস্তায় পড়ে আছে আলগা পাথর। পা পড়লেই সড়াৎ। কোন কিছুই দমাতে পারল না। তাকে। মাথা ঘুরছে। বাচ্চাটার তীক্ষ্ণ চিৎকার বাজছে কানের পর্দায়। পৌঁছে গেল গাড়ির কাছে।
পেছনে থেকে কিছুই করতে পারবে না। পাশে যেতে হবে।
দুই হাত সামনে বাড়িয়ে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল।
হাতলটা ধরতে চায়।
নাহ! আর বোধহয় পারা গেল না! পারল না ধরতে!
চোখ পড়ল রাস্তা পেরোতে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর ওপর।
সরো! সরো তোমরা! ওদের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল সে।
গাড়ির পেছনের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে খুদে খুদে গোলাপী রঙের আঙুলগুলো দিয়ে কাঁচ আঁকড়ে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করছে বাচ্চাটা।
নিজের অজান্তেই গতি বেড়ে গেল মুসার।
জোরে…আরও জোরে…
থাবা দিয়ে ধরতে গেল আবার হাতলটা। আবার মিস করল!
.
০২.
তৃতীয়বারের চেষ্টায় ধরে ফেলল হাতলটা। শক্ত হয়ে চেপে বসল আঙুলগুলো। ছাড়ল না কোনমতেই। গাড়ির পাশে পাশে দৌড়াচ্ছে। একই সঙ্গে টেনে খোলার চেষ্টা করছে দরজাটা।
খুলে গেল দরজা।
মাথা নিচু করে ডাইভ দিল সে। গীয়ে পড়ল সীটের ওপর।
হাত ছুঁড়ছে আর চিৎকার করছে বাচ্চাটা। জড়সড় হয়ে আছে পেছনের সীটে।
সেদিকে তাকানোর সময় নেই। গাড়ির মধ্যে নিজেকে ঠেলেঠুলে সোজা করল মুসা। পা নেমে গেল নিচের দিকে। ব্রেক প্যাডালটা ছুঁতে চাইছে।
পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চেপে ধরল ওটা।
দুলে উঠল গাড়ি। হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ভয়াবহ ঝাঁকুনি।
ড্যাশবোর্ডে ঠুকে গেল মুসার কপাল। তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে গেল সমস্ত শরীরে। যন্ত্রণায় আপনাআপনি চিৎকার বেরিয়ে এল মুখ থেকে। বুজে গেল চোখের পাতা।
গাড়ির প্রচণ্ড ঝাঁকুনি থামিয়ে দিয়েছে বাচ্চাটার চিৎকারও। সীটবেল্ট না থাকলে উড়ে এসে পড়ত সামনের দিকে। যত চিৎকার-চেঁচামেচি এখন গাড়ির বাইরে। কারও মুখ বন্ধ নেই।
আনন্দ আর স্বস্তি জুড়িয়ে দিল যেন মুসার শরীর। পেরেছে সে! সময়মত থামাতে পেরেছে গাড়িটা!
সারা গায়ে ব্যথা। কপাল দপদপ করছে। মাথা ঘুরছে বনবন করে। তুলে রাখতে পারছে না। চোখের সামনে সব যেন উজ্জ্বল লাল। লাল বদলে। সাদা হলো। সাদা আলোটা হাতুড়ির মত বাড়ি মারছে যেন মাথার মধ্যে।
বেহুশ হয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারল।
মায়ের চিৎকার চমকে দিল তাকে। চোখের সামনে থেকে সাদা পর্দার মত সরে গেল বিচিত্র আলোটা। কানের পেছনে চিৎকার করে উঠেছেন মা, আমার খোকা! আমার খোকা!
টের পাচ্ছে মুসা, ঝটকা দিয়ে খুলে গেল পেছনের দরজা। গাড়িতে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছেন মহিলা। বাচ্চার সীট-বেল্ট খুলে নিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলেন। আপ্রাণ চেষ্টা করছে মুসা, যাতে বেহুঁশ না হয়। শরীর কাঁপছে থরথর করে।
অবশেষে মাথা সোজা করল সে। হ্যান্ডব্রেক তুলে দিয়ে বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে। টলে উঠল। মাথা ঘুরছে এখনও। কপালে হাত বোলাল।
গাড়িটাকে ঘিরে ধরেছে ছেলেমেয়েরা। একযোগে কলরব করছে সবাই। সবার চোখ মুসার দিকে।
বাচ্চাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে ছুটে এলেন মা।
এত সাহসী ছেলে জীবনে দেখিনি আমি! বাচ্চার গা থেকে একটা হাত সরিয়ে এনে সে-হাতে জড়িয়ে ধরলেন মুসাকে। তোমার মত সাহস দুনিয়ায় আর কারও নেই! ঘোষণা করে দিলেন তিনি। কি নাম তোমার, বাবা?
মুসা আমান! কোনমতে বলল মুসা। উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় কান গরম হয়ে যাচ্ছে তার।
এগিয়ে এল স্কুলের ছেলেমেয়েরা। কেউ প্রশংসা করতে লাগল, কেউ বা চাপড়ে দিল পিঠ।
দুই গাল বেয়ে পানির ধারা নেমেছে মায়ের। গাড়ি থেকে নেমে একটা চিঠি পোস্ট করতে গিয়েছিলাম, জানালেন তিনি। হ্যান্ডব্রেকটা তুলে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম হয়তো। কি মনে হতে ফিরে তাকিয়ে দেখি গাড়িটা নেমে যাচ্ছে…শুধু আমার ছেলেটাকেই না, কতজনকে যে তুমি আজ বাঁচিয়ে দিলে, মুসা!
তাই কি! বিড়বিড় করল মুসা। প্রচণ্ড শকটা হজম করতে সময় নিচ্ছে। মাথা ঘোরা সারেনি এখনও। পায়ের নিচে যেন মাটি নেই। শূন্যে ভাসছে সে।
মুসাকে ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাকে বুকের এক পাশ থেকে আরেক পাশে সরালেন মা। ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, মুসা করলটা কি দেখলে তোমরা? সাইকেল থেকে চলন্ত গাড়িতে ঝাঁপ-এমন দৃশ্য কেবল সিনেমাতেই দেখা যায়।
না না, ঠিক বলেননি আপনি!-বলতে চাইল মুসা, ঘটনাটা ঠিক এ ভাবে ঘটেনি। কিন্তু কথা বেরোল না মুখ দিয়ে। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। প্রশংসা করছে। পিঠ আর কাঁধ চাপড়ানোর ধুম পড়ে গেছে। প্রতিবাদ করারও সুযোগ পেল না সে।
আরেকটু হলে নিজেই মরত! বলে চলেছেন মুহিলা। কিন্তু অন্যকে বাঁচানোর জন্যে প্রাণের পরোয়া করেনি। অত সাহস জীবনে দেখিনি আমি!
মহিলার কথা সমর্থন করে সম্মিলিত চিৎকার উঠল।
দুই হাত জিনসের পকেটে ঢুকিয়ে দিল মুসা। দেহের কাঁপুনি থামানোর চেষ্টা করছে।
নিজেকে ওর অত সাহসী লাগছে না। হিরো মনে হচ্ছে না। কারণ ঘটনাটা ঘটেছে অন্যভাবে। লাফ দিয়ে সাইকেল থেকে গাড়ির ওপর পড়েনি। বরং সাইকেল থেকে পড়ার পর গাড়িটাকে ছুটে আসতে দেখে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে লাফিয়ে সরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পেছনের সীটে অসহায় বাচ্চাটাকে দেখে কি যেন কি হয়ে গিয়েছিল, ছুটতে শুরু করেছিল পেছন পেছন…ব্যস, ওই পর্যন্তই।