আমার মাথায়ই ঢুকছে না, মেঝেতে পা ছড়িয়ে দিয়ে, দুই হাত পেছনে নিয়ে গিয়ে তাতে ভর দিয়ে শরীরটা উঁচু করে রেখেছে টেরি। আমি ভেবেছি, দেখামাত্র লেজ তুলে দৌড় দেবে তুমি। কিংবা বাবাগো-মাগো চিৎকার দিয়ে ভিরমি খেয়ে পড়বে।
খলখল করে হেসে উঠল কিশোর। তাহলেই বোঝো, শুঁটকি, তোমার ক্ষমতা। হাত বাড়াল, আজ আর মাপ করছি না। টাকাটা দিয়ে দাও। তোমরা হেরেছ।
কিন্তু কথা যেন কানেই ঢুকছে না টেরির। শক পাওয়া মানুষের মত বিড়বিড় করেই চলল, তুমি টেনে আমার মুখোশ খুলে নিলে! জানো বলেই নিয়েছ। কি করে জানলে? কি করে?
মুসার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল কিশোর। মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে বোঝাল-বোলো না, খবরদার!
চুপ করে রইল মুসা। সে যে ভয় পেয়েছে, আতঙ্কে আরেকটু হলে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল–জানতে পারলেই আবার পেয়ে বসবে টেরির দল।
শুঁটকি না হলে এ রকম ছাগুলে বুদ্ধি কেউ করে? তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়ল কিশোর। ছ্যাহ! মুখোশ পরে মরা লাশ সাজে। মুসা আমান তো বিরাট ব্যাপার, একটা দুধের বাচ্চাও ধরে ফেলতে পারত এটা। আসল লাশকেই যে ভয় করে না, সে তোমাকে ভয় পাবে ভাবলে কি করে?
এতক্ষণে যেন সংবিত ফিরল টেরির। উঠে দাঁড়াল। তাই নাকি?
লজ্জা থাকলে আবার তাই নাকি বলছ। তুমি তো জ্যান্ত মানুষ, সত্যিকারের মরা লাশ থাকলেও কফিনে ঢুকতে পারবে মুসা, ঘোষণা করে দিল কিশোর। সামান্যতম বুক কাঁপবে না ওর। একবার মর্গে ঢুকে আমি আর রবিন ভয়ে দিলাম দৌড়, হাসতে হাসতে গিয়ে লাশের গালে গাল ঘষতে লাগল সে।
কিশোর, দোহাই তোমার! চুপ করো! আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে উঠল মুসা। মুঠো শক্ত হয়ে গেছে তার। এই জঘন্য খেলা…
দেখলে, কি বিনয়? প্রশংসা পর্যন্ত সইতে পারছে না।
চোখের পাতা সরু হয়ে এল টেরির। মুসার কাঁধ থেকে টোকা দিয়ে লাশ বাধা দড়ির একটা টুকরো ফেলল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আসল লাশকেও তাহলে ভয় পাও না?
ইয়ে… বলতে গেল মুসা।
না, পায় না, মুসাকে কথা বলতে দিল না কিশোর।
ওর দিকে ঘুরল টেরি। বেশ। একটা শেষ বাজি। মুসার সর্বশেষ পরীক্ষা…।
তুমি ওর পরীক্ষা নেয়ার কে? রেগে উঠল রবিন।
বেশ, পরীক্ষা নয়, হাসল টেরি, ফাইন্যাল চ্যালেঞ্জ।
চ্যালেঞ্জ, শব্দটা এমন ভঙ্গিতে বলল টেরি, ভয় পেয়ে গেল মুসা।
পাঁচশো ডলার বাজি, কিশোরকে বলে মুসার দিকে তাকাল টেরি। সহসাই আবার দেখা হবে আমাদের, মু-ম্মুসা। খুব শীঘ্রি। এখানে। এই ঘরে।
হাত বাড়াল কিশোর, টাকাটা! মাপ চাইলে অবশ্য মাপ করে দিতে পারি।
দ্বিধা করল টেরি। তারপর পকেটে হাত ঢোকাল। বের করে আনল শূন্য হাতটা। আনতে ভুলে গেছি। একবারেই নিও।
.
১৫.
পরের রাতে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে মুসা। এর একটা বিহিত Wil করতেই হবে। বন্ধ করতে হবে এই যন্ত্রণা। এ ভাবে সারাক্ষণ মানসিক চাপের মধ্যে থাকার চেয়ে তোতলা মুসা হওয়া বরং অনেক ভাল।
কিশোরকে ফোন করল সে। তৃতীয়বার রিঙ হতে তুলে নিল কিশোর, হালো, কিশোর পাশা বলছি।
আমি। মুসা।
ও, মুসা। কি খবর? থার্ড চ্যাপ্টারের অঙ্কগুলো মিলছে না তো?
জাহান্নামে যাক অঙ্ক! অঙ্ক নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না আমি। এত মানসিক চাপ নিয়ে হোমওঅর্ক করা যায় না।
মানসিক চাপ? অবাক হলো কিশোর। কিসের?
কিসের, জানো না?
টেরির ফাইন্যাল চ্যালেঞ্জ।
অ, হাসল কিশোর, ওটা কোন চাপ হলো নাকি? যাব আবার। লাশের কফিনে শুয়ে দেখিয়ে দেবে তুমি। ব্যস, হয়ে গেল। পাঁচশোটা কড়কড়ে ডলারও এসে যাবে, তুমিও হিরো হয়ে যাবে স্কুলে। কেউ আর তোমাকে তোতলা মুসা বলে খেপাবে না।
খেপালে খেপাক! মড়ার সঙ্গে শুতে পারব না আমি। মর্গের মিথ্যে কথাটা কেন বললে ওদের?
মুসা, এখন এ সব সাধারণ কথা নিয়ে আলোচনার সময় নেই। অঙ্কগুলো শেষ করতে হবে। রাখি? পরে দেখা হবে।
ফোন রেখে দিল কিশোর।
রাগে জ্বলতে লাগল মুসা। রবিনকে ফোন করল।
সব কথা শুনে রবিন বলল, কিশোরের কাজ-কারবার আমারও কেমন অবাক লাগছে। কিন্তু বিনা কারণে তো কিছু করে না ও। ওর মনে কি আছে ও-ই জানে।
টেরির এই শয়তানিটা বন্ধ করা দরকার।
হ্যাঁ, দরকার।
তাহলে কিছু একটা করো। সাহায্য করো আমাকে। আমি ভাবলাম, রকি বীচে এসে কত না আরামে থাকব। কিন্তু এ যে গ্রীন হিলসের চেয়েও খারাপ অবস্থা।
অস্থির হয়ো না, মুসা। টেরির দল তোমার কিছু করতে পারবে না।
রবিনের কথায় খানিকটা সান্ত্বনা পেল মুসা।
ফোন রেখে দিয়ে বিছানায় বসল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেজে উঠল আবার। ভাবল রবিন করেছে। কিন্তু কানে ঠেকানোর সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল একটা ব্যঙ্গভরা কন্ঠ, কি ব্যাপার, মু মুসা? কার সঙ্গে এত বকরবকর করছিলে? তোমার প্রেতাত্মার সঙ্গে?
টা-টা-ট্টাকি!
হ্যাঁ, টা-টা-ট্টাকি! শোনো, টেরি বলেছে, ফাইন্যাল বাজিটা হবে কাল রাতে। ফিউনরল পারলারেই। কাল রাত, মনে রেখো। ভুললে, বাজি হারবে।
*
পরদিন। পাশাপাশি হাঁটছে কিশোর আর মুসা। পরিষ্কার রাত। সেদিনের মত বৃষ্টি নেই। তবে কনকনে ঠাণ্ডা। একফালি ফ্যাকাশে চাঁদ ভেসে বেড়াচ্ছে বাড়ি-ঘরের ছাতের ওপর নীলচে-ধূসর আকাশে। গাছগুলো আজ শান্ত, নিথর।
টেরিদের বাড়ির বাইরে তাকে আর তার বন্ধুদেরকে পাওয়া গেল। কিশোরদের জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। কিশোররা আসতে সবাই মিলে দল বেঁধে চলল ফিউনরল পারলারে।