না, আলো জ্বালানো চলবে না, টাকি বলল। ঠিক আছে, কফিনটা কোনখানে দেখানোর ব্যবস্থা করছি। একটা টর্চ বের করে জানালার ফ্রেমের ওপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে জ্বালল সে। ম্লান একটা গোল আলো গিয়ে পড়ল মেঝেতে।
কয়েক পা এগিয়ে গেল মুসা। আলোটা স্থির হয়ে আছে এক জায়গায়।
পেছনে আরেকটা টর্চ জ্বলে উঠল। কডি জ্বেলেছে। আলো দুটো খুদে স্পটলাইটের মত ঘুরে বেড়াতে লাগল মেঝেতে।
সেই আলোর আভায় যতটা সম্ভব ঘরটা দেখে নিতে লাগল মুসা। ছাত একেবারেই নিচুতে। ওর মাথার ফুট দুই ওপরে। পাশাপাশি রাখা দুটো ধাতব টেবিল দেখতে পেল। একটা খালি। আরেকটার ওপর লম্বা কোন জিনিস প্ল্যাস্টিকের চাদর দিয়ে ঢাকা। তলায় কি আছে বুঝতে অসুবিধে হলো না ওর।
একদিকে একটা ডেস্কের ওপর রাখা কাগজ ফড়ফড় করছে বাতাসে। দেয়াল ঘেঁষে রাখা একসারি ফাইলিং কেবিনেট। নানা রকম কয়েল আর টিউব। হাসপাতালের ঘরের মত। ওগুলোর পাশে নিচু টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা কালো রং করা কফিনের সারি। টর্চের আলোর আভায় চকচক করছে।
খাইছে! ঝুলে পড়ল মুসার নিচের চোয়াল।
ভয় পাচ্ছো, কালটু মিয়া? কড়ি জিজ্ঞেস করল। হাতের আলোটা ঝটকা দিয়ে উঠে এল মুসার মুখের ওপর।
আলো নামাও, গাধা কোথাকার! দেখব কি করে? ধমকে উঠল মুসা।
কফিনগুলো তো দেখলে, টাকি বলল। ওই যে, প্রথম কফিনটা। যাও। টর্চের আলো ফেলে কোন কফিনটাতে ঢুকতে হবে দেখিয়ে দিল সে।
ভয় পাচ্ছে! নিটু বলল। এই, জানালার কাছ থেকে সরে যাও তোমরা। মু-ম্মুসাকে পালানোর পথ করে দাও।
ও পালাবে না, পালাবে না, পালাবে না! চিৎকার করে উঠল কিশোর। কতবার বলব? তোমাদের মত মুরগীর কলজে নাকি ওর? …যাও, মুসা, এগোও। শুয়ে পড়োগে কফিনটার মধ্যে। টাকা আয়ের খুব সহজ রাস্তা।
সহজ, তবে তোমার জন্যে-মনে মনে বলল মুসা। ঈশপের গল্পের একটা উপমা মনে পড়ল: তোমাদের জন্যে খেলা বটে, আমার জন্যে মরণ! কফিনগুলোর ওপর চোখ বোলাতে বোলাতে ভাবল, সত্যি কি পারবে ঢুকতে? কেমন লাগবে? ভেতরের গন্ধটা কেমন?
বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটাচ্ছে। জানালার দিকে ফিরল সে। জিজ্ঞেস করল, কফিনে শুয়ে কি ডালা নামিয়ে দিতে হবে?
ঢোকো, অধৈর্য কণ্ঠে টাকি বলল, শুধু ঢুকলেই হবে। আর কিছু করতে হবে না তোমাকে, মু-ম্মুসা! বাকিটা যার করার সে-ই করবে, রহস্যময় শোনাল তার কথা। জলদি করো। বাইরে যা ঠাণ্ডা।…পারবে? না পারলে চলে এসো।
পারবে না মানে? জোরগলায় বলল কিশোর। অবশ্যই পারবে। এ কোন ব্যাপার হলো!
ধীর পায়ে কফিনগুলোর দিকে এগিয়ে চলল মুসা। টর্চের আলো দুটো স্থির হয়ে আছে পেছনের সবুজ দেয়ালে। কফিনের ডালা নামানো।
যাও, মুসা, যাও! ঢুকে পড়ো! ও কোন ব্যাপারই না তোমার জন্যে! জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে মুসাকে অভয় দিল কিশোর। তাতে আরও পিত্তি জ্বলে গেল মুসার। অন্যকে পরামর্শ দেয়া সোজা!
ও এত দেরি করছে কেন? অস্থির হয়ে উঠেছে কডি। মুসার দুর্গতি দেখার জন্যে তর সইছে না যেন আর।
কফিনের ডালার ওপর হাত নামাল মুসা। কাঠের অনুভূতিটা মসৃণ, শীতল। এত জোরে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
ডালা তোলো, মুসা-নিজেকে বোঝাল সে। তারপর ঢুকে পড়ো ভেতরে। কি আর হবে? খাট আর চৌকির মত কফিনও কাঠেরই তৈরি। সাধারণ বাক্সের মত। নিচে গদি আছে। বাক্সের ভেতরে শুলে বিছানার মতই লাগবে।
সবুজ দেয়ালে নড়ে উঠল দুটো আলোর একটা। আবার স্থির হলো।
ডালার কিনার চেপে ধরে ভারী দম নিল মুসা। টেনে উঁচু করে ঠেলে দিল ওপর দিকে। পুরোটা খুলে ফেলল। তারপর তাকাল ভেতরে।
তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে আসতে শুরু করল গলার গভীর থেকে।
.
১৩.
কাচের চোখের মত নিষ্প্রাণ দুটো চোখ। কালচে ঠোঁটে স্থির হয়ে আছে রক্ত পানি করা অস্বাভাবিক হাসি। নিচের ঠোঁটের ওপর নেমে এসেছে ওপরের পাটির একটা মাত্র দাঁত। ওই একটাই। মুখে আর কোন দাঁতই নেই। কপালে আর গালে গভীর কাটা দাগ। হাত দুটো বুকের ওপর আড়াআড়ি রাখা।
চিত হয়ে আছে লাশটা। স্তব্ধ। নিথর।
চিৎকারটা বেরোয়নি মুসার মুখ থেকে। নিজে নিজেই বন্ধ করেছে না অতিরিক্ত ভয়ে আটকে গেছে, বলতে পারবে না।
জানালার কাছ থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, মুসা, কি হয়েছে?
এ-একটা…লা-লা-লাশ, কাঁপা কণ্ঠে জবাব দিল মুসা। কফিনের দিকে আঙুল তুলল।
বললাম না ও ভয় পাবে, হারল্ডের কণ্ঠ কানে এল তার। চেঁচিয়ে গলা ফাটাবে।
তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিকৃত হাসি হাসতে লাগল তার বন্ধুরা।
কডি বলল, আমি শিওর, এইমাত্র যে লাশটা আনল, ওটাই রেখে গেছে ওই কফিনে।
আবার হেসে উঠল ওরা।
অত হাসির কি হলো? ধমকে উঠল মুসা। এখানে একটা মানুষের লাশ রয়েছে। মৃতদেহ। এতে হাসির কি দেখলে? দেখি আলোটা নামাও নিচের দিকে।
পেটের মধ্যে মোচড় দিচ্ছে তার। গলাটা এমন শক্ত হয়ে গেছে, নিঃশ্বাস ফেলার সময় চাপা শিসের মত শব্দ বেরোচ্ছে।
টর্চের আলো নিচে নামল। কিন্তু কফিনের গায়ে পড়ছে আলো, ভেতরে ঢুকতে পারছে না। কোনমতেই চেহারাটা স্পষ্ট হচ্ছে না।
ভয় পাচ্ছ নাকি? জিজ্ঞেস করল টাকি।
ও পারবে না, ঘোষণা করে দিল হ্যারল্ড।
তারমানে আমরা জিতে গেলাম, বলল কডি। দুশো ডলার!
গায়ের জোরের জেতা নাকি? কাজই শেষ হলো না এখনও, কর্কশ শোনাল কিশোরের কণ্ঠ। মাথাটা ঠেলে দিল জানালার ভেতরে। মুসা, ঢুকে পড়ো। শুয়ে পড়ো লাশটার ওপর। ও কিছু না। পারবে তুমি।…ও, দেখতে পাচ্ছো না? …এই, আলোগুলো ঠিকমত ফেলো তোমরা। না দেখলে কোথায় ঢুকবে?