হতাশ ভঙ্গিতে জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল টার্কি। টুপিটা মাথায় দিল আবার। যাবেই?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর, হ্যাঁ।
বেশ। কোট-টোটগুলো পরে এসো আমার সঙ্গে।
*
টাকির সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। দরজায় তালা দিল মুসা। ওর বাবার কাছে বাড়তি চাবি আছে। দরজা খুলতে অসুবিধে হবে না।
অক্টোবরের ঠাণ্ডা রাত। তা ছাড়া শীতটা এবার তাড়াতাড়ি পড়াতে ঠাণ্ডাটা জাকিয়ে বসেছে। তার ওপর রয়েছে ঝোড়ো বাতাস, লনের শুকনো ঝরা পাতায় ঘূর্ণি তুলছে। পাতাহারা শূন্য গাছগুলো বাতাসের ঝাপটায় যেন পাতার শোকেই গুঙিয়ে উঠছে বারবার, বিচিত্র শব্দে আর্তনাদ করছে।
বৃষ্টির দুচারটা ঠাণ্ডা ফোঁটা এসে পড়ল মুসার কপালে। গায়ের কালো পারকাটার জিপার টেনে দিল সে। মাথায় তুলে দিল হুড।
টাকির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মোড়ে চলে এল তিন গোয়েন্দা। সশব্দে বড় রাস্তা ধরে চলে গেল একটা বাস। ভেতরে যাত্রী মাত্র। দুতিনজন।
বাসটা চলে গেলে নির্জন রাস্তা পেরোল ওরা। হাঁটতে থাকল।
কোথায় চলেছে জানে মুসা। আগেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে টেরি। বলার সময় টেরির তিলে ভরা মুখটার উজ্জ্বলতা কল্পনা করে মনে মনে দমে গেল সে।
একটা পার্কিং লটের পেছনে পাতাবাহারের বেড়ার কাছে এসে থামল ওরা। ওপাশে অন্ধকার লম্বা একটা বিল্ডিং। সামনে কাঠের সাইনবোর্ডের ওপর জ্বলছে হলুদ স্পটলাইট। লেখাগুলো পড়া যায়: দা এন্ডলেস স্লীপ!
অনন্ত ঘুম! বাংলায় বিড়বিড় করল কিশোর।
ফিরে তাকাল রবিন। বুঝতে পারল, বোর্ডের লেখাগুলোর বাংলা অনুবাদ করেছে কিশোর। চুপ করে রইল।
ফিউনরল পারলারটার মালিক টেরির বাবা।
বাড়িটার দিকে তাকিয়ে গায়ে কাঁটা দিল মুসার। ভেতরে কি লাশ আছে এখন? মানুষের মৃতদেহ? নিশ্চয় আছে-নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই দিল মনকে মুসা। ফিউনরল পারলার মানেই তো লাশ রাখা, কবর দেয়ার আগে গোসল করানো, কাপড় পরানো, সুগন্ধি মাখিয়ে কফিনে ভরার জন্যে তৈরি করার জায়গা।
পারকার পকেটে যতটা যায়, হাত দুটো ঠেলে ঢোকাল সে। পাশে দাঁড়ানো কিশোরের দিকেও তাকাতে ইচ্ছে করছে না। টেরিকে এতখানি আগে বাড়তে দেয়ার জন্যে সে-ই দায়ী। কি দরকার ছিল এ সব বাজি ধরাধরির!
অ্যাই যে, এসে গেছে আমাদের সুপারহিরো! কানের কাছে কথা বলে উঠল কডি, চাপড়ে দিল মুসার পিঠ।
এত চমকে গেল মুসা, মনে হলো দশ হাত শূন্যে লাফিয়ে উঠেছে।
ছায়া থেকে বেরিয়ে এল নিটু আর হ্যারল্ড। কডির পাশে দাঁড়াল।
টেরি কোথায়? জানতে চাইল কিশোর।
এক ঝলক ঝোড়ো বাতাস কাঁপুনি তুলল পাতাবাহারের বেড়ায়। আধো অন্ধকারে বেড়ার ওপরের অংশের কাঁপুনি দেখে মনে হলো এঁকেবেঁকে চলে গেল একটা বিরাট সাপ। বাতাসের ঝাপটায় মাথার হুড পেছনে খসে পড়ল মুসার। সঙ্গে সঙ্গে কপালে লাগল বৃষ্টির ফোঁটা।
টেরিকে আটকে ফেলেছে, জবাব দিল টাকি।
আটকে ফেলেছে? মুসা অবাক। কই, আগে তো বলনি?
মাথা ঝাঁকাল টাকি, হ্যাঁ, আটকে ফেলেছেন, ওর বাবা। চুপি চুপি বেরোতে যাচ্ছিল টেরি, ধরা পড়ে গেছে।
মজাটা আর উপভোগ করতে পারল না আজকে, হেসে বলল কডি।
মজা না ছাই! তেতো হয়ে গেছে মুসার মন।
চিন্তা কোরো না, মুসা, কড়ি বলল। ত্রাহি চিৎকার করে কিভাবে ছুটে পালিয়েছ তুমি, মুখে বলেই সেটার ছবি দেখিয়ে দেব আমরা ওকে।
ত্রাহি চিৎকার মুসা নয়, তোমরা করবে, গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। সেই সঙ্গে মাতম। চাপড়ে চাপড়ে রক্তাক্ত করে ফেলবে কপাল, এতগুলো টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার শোকে।
ফিউনরল পারলারের দিকে তাকাল আবার মুসা। সাধারণ দেখতে, অনেক লম্বা, একতলা একটা বাড়ি। অস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু মুসার কাছে ভয়ানক অস্বাভাবিক লাগল। কালো, অশুভ, ভুতুড়ে একটা বাড়ি-হরর সিনেমার বাড়িগুলোর মত।
ভেতরে সারি দিয়ে রাখা কফিনগুলো কল্পনা করল সে। ধাতব টেবিলে চিত করে ফেলে রাখা অসংখ্য লাশ।…কফিনের ডালা একের পর এক উঠে যেতে শুরু করল…দেখা দিল পচে বিকৃত হয়ে যাওয়া লাশের মাথা… সবুজ হয়ে যাওয়া লাশগুলো বেরিয়ে আসতে লাগল…টলছে, গোঙাচ্ছে। এগিয়ে আসতে লাগল মাংস খসে পড়া ফোলা ফোলা হাত বাড়িয়ে দিয়ে। বড় বড় ময়লা নখওয়ালা আঙুলগুলো বাঁকা করে রেখেছে তাকে খামচে ধরার জন্যে। বসে যাওয়া কোটরে নিষ্প্রাণ চোখগুলোর দিকে তাকানো যায় না…।
থামো! আর এগিয়ে না! নিজেকে ধমকে উঠল মুসা। মনে মনে। বেপরোয়া কল্পনার রাশ টেনে থামানোর চেষ্টা করল।
ঢোক গিলল একবার। মাথা ঝাড়া দিল। হাত দিয়ে মুছল বৃষ্টি ভেজা কপাল। টাকির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি করতে হবে আমাকে, বলো!
.
১০.
মুসার প্রশ্ন হাঁ করিয়ে দিল টাকি আর তার তিন দোস্তকে। সবার আগে সামলে নিল কডি। নিষ্ঠুর, শীতল হাসি হাসল। সে তাতে যোগ দিল নিটু আর হ্যারল্ড।
টাকি হাসল না। গম্ভীর হয়ে বলল, আমি তোমাকে এখনও কাজটা না করতে অনুরোধ করব, মুসা।
কেন, তোমার হঠাৎ এত মুসার জন্যে দরদ উথলে উঠল কেন? কিশোর বলল। ওর নাটকে কান দিয়ো না, মুসা। কথা বুলে ভয় দেখিয়েই ও তোমাকে কাবু করে ফেলার চেষ্টা করছে।… শোনো টাকি, আমি বলি কি, অকারণে সময় নষ্ট না করে টাকাগুলো দিয়ে বিদেয় হও। টেরিকে গিয়ে বোলো, বাজিফাজি খতম। কত আর বলব, মুসা কোন কিছুকে ভয় করে না।