মরফি পড়ে যেতেই হাততালি দিতে শুরু করল মুসার পক্ষের সমর্থকরা। হাসতে লাগল। শিস দিল।
কাবু হয়ে গেছে মরফি। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল। মুখ টকটকে লাল।
হঠাৎ জেগে ওঠা আবেগ কেটে গেছে মুসার। ভয়টা ফিরে এসেছে। মরফি যখন হুমকি দিল, দেখে নেব আমি! ছাড়ব না!-এক পা পিছিয়ে গেল মুসা।
সামনে এসে দাঁড়াল কিশোর। এখনও বাহাদুরি? বড় বড় কথা! যাও যাও, যা পারো কোরো। মুসা আমান কাউকে ভয় পায় না।
জ্বলে উঠল মরফির চোখ। পারলে কিশোরকেই মেরে বসে। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারল না। লকার থেকে রবিনও বেরিয়ে চলে এসেছে ততক্ষণে। তিনজনের সঙ্গে কোনমতেই পারবে না বুঝে মানে মানে কেটে পড়ল ওখান থেকে।
তার সঙ্গে চলে গেল তার সমর্থকরা।
বাকি সবাই প্রচুর চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। কেউ শতমুখে প্রশংসা করতে লাগল মুসার। কেউ বা এসে পিঠ চাপড়ে দিয়ে আন্তরিকতা প্রকাশ করল।
চারপাশে তাকিয়ে টাকিকে কোথাও দেখল না কিশোর। মুচকি হাসল সে। টেরির আরেকটা প্ল্যান বরবাদ হয়েছে।
*
লাঞ্চের পর আবার ক্লাস। সবাই আরেকবার হিরোর সম্মান দিতে লাগল মুসাকে। মেজাজটা তাই ওর ফুরফুরে লাগছে। আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে শুরু করেছে। যে ভাবে এগোচ্ছে, এখানে তাকে তোতলা মুসা বলার সাহসই পাবে না হয়তো আর কেউ। বিশেষ করে মরফিকে পেটানোর পর।
কিন্তু ক্লাস শেষে এমন একটা ঘটনা ঘটল, আবার চুরমার হয়ে গেল তার বিশ্বাস। ফিরে এল পুরানো ভয়টা। ঘণ্টা বাজার পর ক্লাস থেকে বেরিয়ে লকারের দিকে এগোচ্ছে, হঠাৎ কানে এল টেরি আর টাকির কথা। নিজের নাম শুনে থমকে দাঁড়াল মুসা। কান খাড়া করে শুনতে লাগল।
টাকি বলছে, সত্যি করবে?
নিশ্চয়ই, জবাব দিল টেরি। মরফি হাদাটা যে এমন করে কেঁচে দেবে সব কে জানত!…তবে আমি কেলোটাকে মু-ম্মুসা না বানিয়ে ছাড়ব না।
একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। মনে হলো, টেরি আর টাকি তাকে দেখেছে। তাই নিজেরা কথা বলার ছলে ইচ্ছে করেই এ সব শোনাচ্ছে।
কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে, টেরি, টাকি বলল। এত ভয়ানক!…নাহ এতটা করা ঠিক হবে না।
এতটাই করব! শুধু তাই না, দরকার হলে আরও ভয়ঙ্কর কিছু করতেও দ্বিধা করব না আমি।
.
০৯.
কয়েক রাত পর। মুসাদের ডাইনিং রূমের টেবিলে হুমড়ি খেয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। সবাই মিলে হোমওঅর্ক করছে। মুসার বাবা-মা বাড়ি নেই। বাড়িতে সে একা। তাই ফোন করে আনিয়ে নিয়েছে দুই বন্ধুকে। তিনজনেই গভীর মনোযোগে অঙ্কের সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত।
এই সময় দরজার ঘণ্টা বাজল। এতটাই চমকে গেল মুসা, কাগজে চাপ লেগে পেন্সিলের সীস ভেঙে গেল। হঠাৎ করেই মনে হলো তার, নিশ্চয় টেরির দল। আবার এসেছে তার সাহস পরীক্ষা করতে।
এত আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই-মনে মনে নিজেকে বোঝাল মুসা। দেখাই যাক না আগে কে এসেছে।
উঠে দরজা খুলতে এগোল সে। পেছন পেছন চলল কিশোর।
দরজা খুলে দিল মুসা। ঠিকই অনুমান করেছে সে। টেরির বাহিনীই। ঘরে ঢুকল টাকি। গায়ে নীল জ্যাকেট। মাথায় উলের স্কি হ্যাট। বাপরে বাপ, বাইরে কি ঠাণ্ডা!
টান দিয়ে টুপিটা খুলে নিয়ে অস্বস্তিভরে চারপাশে তাকাতে লাগল সে। মুসা, সত্যি ভাই, আমি দুঃখিত। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি ওকে। থামাতে পারিনি?
তাই নাকি? মুসার আগেই জবাব দিল কিশোর, কিসের দুঃখ? কাকে থামাতে পারনি।
উঠে এসে রবিনও দাঁড়াল ওদের পেছনে। আরে ধূর, কিসের থামাথামি! হাত নেড়ে বলল সে। বুঝতে পারছ না, নাটক করে মুসাকে ঘাবড়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।
কিন্তু তাতে কোনই লাভ হবে না, বুড়ো আঙুল নাড়ল কিশোর। ঘটে সামান্যতম ঘিলু থাকলে এতদিনে বুঝে যাওয়া উচিত ছিল ওদের, মুসাকে ওরা ভয় দেখাতে পারবে না।
কিন্তু, দেখো, কিশোর, শান্তকণ্ঠে বলল টাকি, মুসা তোমার বন্ধু। উত্তেজিত করে করে এ ভাবে ওকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়া তোমার উচিত হচ্ছে না। তোমরা জানো না টেরি এবার কি করতে চলেছে। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি ওকে। শুনল না। সে করবেই করবে। এ বাজি তাকে জিততেই হবে।
অজানা আশঙ্কায় মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেল মুসার। সেদিন স্কুলে আড়ালে দাঁড়িয়ে শোনা কথাগুলো মনে পড়ে গেল। ভাঁজ হয়ে আসতে চাইল হাট। টাকি যাতে বুঝতে না পারে, সেভাবে সরে গিয়ে একটা কাউচের হেলান খামচে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। ভাবছে, বাদ দেয়া দরকার এ খেলা! টেরিকে বিশ্বাস নেই। বাজি জেতার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। কি করবে কে জানে!
আমি টেরির সঙ্গে একমত হতে পারলাম না বলেই তোমাদের সতর্ক করে দিতে এলাম, টাকি বলল। ভয়ানক কোন বিপদ যদি ঘটে যায় পরে আমাকে দোষ দিতে পারবে না।
ঢোক গিলল মুসা।
ভয়ানক কোন বিপদে যদি পড়ে কেউ, শীতল কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর, তো পড়বে তোমার ওস্তাদ শুঁটকি আর বাকি চামচাগুলো। মুসার কিছু হবে না। তোমার ওস্তাদকে গিয়ে বলে দাও, ইচ্ছে সে করতে পারে। তবে এবার আর টাকা মাপ করব না আমরা। দুশো ডলার যেন রেডি রাখে।
টাকাটা বরং তোমরাই নিয়ে যেয়ো পকেটে করে। মুসার দিকে তাকাল টাকি, মুসা, মনে রেখো বিপদটা তোমার হবে, আর কারও না।
কটাক্ষটা যে তাকে উদ্দেশ্য করেই করা হয়েছে, বুঝতে পারল কিশোর। তুমি আসলে বেশি কথা বলো। কে বলেছে তোমাকে ভালমানুষী দেখাতে আসতে? মুসা চ্যালেঞ্জটা নিয়েছে, যত বিপজ্জনকই হোক। ওসব বোলচাল না ঝেড়ে কি করতে হবে এখন তাকে, সেটা বলো।