অবাক কাণ্ড! মুসা বলল, এখানকার সব কিছুই বিশাল, কেবল পিগমিরা বাদে। তোমরা, উয়াটুসিরা দুনিয়ার সবচেয়ে লম্বা মানুষ। এখানকার হাতিগুলো একেকটা দানব। ফুল বড়, গাছ বড়, এমনকি অতি সাধারণ একটা কেঁচো, তা-ও সাপের সমান। ব্যাপারটা কি?
আউরো কিছু বলার আগেই পেছনের পর্বত থেকে ভেসে এল বিকট আওয়াজ। গায়ে আসার পর এই শব্দ আরও শুনেছে ওরা, কিশোর বলেছে-পর্বতের গা থেকে কয়েক লক্ষ টন বরফ ভেঙে পড়ার আওয়াজ। কিন্তু উয়াটুসিদের বক্তব্য আলাদা।
আতঙ্কে গোল গোল হয়ে গেল আউরোর চোখ। তুমি বলছ আমরা বড়, কিন্তু আমাদের চেয়েও অনেক বড় সে!
সে? সে কে?
বজ্রমানব। সবচেয়ে লম্বা গাছটার চেয়েও লম্বা সে। হেঁটে যাওয়ার সময় মাটি কাঁপে থরথর করে। কথা বলার সময় মনে হবে হাজারখানেক সিংহ গর্জন করছে। তোমরা যাকে বিদ্যুৎ চমকানো বলো, আসলে সেটা হলো তার চোখের দষ্টি-রেগে গেলে অমন করেই জ্বলতে থাকে। সেই আগুন গাছে আঘাত হানলে গাছ ভেঙে পড়ে। গাঁয়ের ওপর পড়লে ঘরবাড়ি সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সে আসে রাতের বেলা, চুপি চুপি। প্রথমে আমাদের গরু-ছাগল নিয়ে যেত। এখন মানুষও ধরে নিয়ে যায়। সন্ধ্যা নামলে আসে, ভোরের আগেই চলে যায়।
অতই যদি শক্তিশালী, চোরের মত আসে কেন?
তা বলতে পারব না।
আসলে সে ভীতু। নয়তো অন্যায় কিছু করে। সেজন্যেই চুপি চুপি আসে।
ওরকম করে বোলো না! ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাতে লাগল আউরো। বজ্রমানবকে চেনো না! তার বিরুদ্ধে কথা বললে তোমাদেরও ছাড়বে না। তোমাদের মারবে, তোমাদের জন্ত-জানোয়ার সব কেড়ে নেবে।
হ্রদের একপাশে গ্রাম। অন্য পাশে পানিতে নেমে এসেছে বন। গাছের নিচে কালো ছায়া।
অন্ধকার হয়ে আসছে, আউরো বলল। বাড়ি চলে যাওয়া উচিত।
লগি বেয়ে ভেলাটাকে তীরে নিয়ে এল ওরা। মাছ দুটো এবং বাকি কেঁচোর পুরোটাই মুসাকে দিয়ে দিতে চাইল আউরো।
মুসা জিজ্ঞেস করল, কেঁচো দিয়ে কি করব?
রান্না করে খাবে। খুব স্বাদ।
ওয়াক, থুহ! বলে কি! কেঁচো আবার খায় নাকি! সাপ হলেও কথা ছিল। তোমরা সাপ খাও?
খাব না কেন? সাপের মাংস খুব ভাল, মুরগীর মাংসের চেয়ে নরম আর রসাল। কেঁচোর মাংস আরও ভাল, কারণ এগুলোর হাড় নেই।
হাড় থাকুক আর না থাকুক, খিদেয় মরে গেলেও কেঁচো খেতে পারবে না মুসা।
মাছগুলো আমি নিয়ে যাই, বলল সে, কেঁচোটা তুমিই নাও। মাছ ধরতে নিয়ে গিয়ে অনেক মজা দিলে, ধন্যবাদ তোমাকে। সকালে দেখা হবে।
তাবুতে এসে মাছ দুটো রান্না করার জন্যে বাবুর্চির হাতে দিল মুসা। খেতে বসে বজ্রমানবের কাহিনী বন্ধুকে শোনাল সে।
কেমন গাঁজা মনে হয় না? মুসা বলল।
হয়ও, আবার না-ও, বলল কিশোর। যারা বিশ্বাস করে তাদের হদ্দ বোকা বলতে পারো। তবে এটাই স্বাভাবিক।
স্বাভাবিক! গাছের চেয়ে লম্বা, বস্ত্র নিক্ষেপ করে, গরু-মানুষ এ সব চুরি করে, এমন মানুষের গল্প তুমি বিশ্বাস করো!
আমি না করলেও দুনিয়ার অনেকেই এ ধরনের আজগুবী গল্প বিশ্বাস করে, বিশেষ করে বনের লোকেরা। আমাদের মত তো সভ্য জগতে বাস করে না ওরা, স্কুলে লেখাপড়া শেখার সুযোগ পায় না। বজ্রপাত, ভূমিকম্প, বন্যা, এ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেন ঘটে, তার বৈজ্ঞানিক কারণ জানে না। কুসংস্কার থাকবেই ওদের। তাই ওদের বিশ্বাস এসব ঘটানোর মূলে থাকে দুটো শক্তি-হয় দেবতা, নয়তো শয়তান। এই গাঁয়ে গরু-ছাগল হারাচ্ছে, ছেলেমেয়ে নিরুদ্দেশ হচ্ছে, ভয় ওরা পাবেই। আমারই তো চিন্তা হচ্ছে।
তার মানে বজ্রমানবের গল্পটা তুমি বিশ্বাস করছ?
ওরা যে ভাবে করছে সেভাবে করি না। আমার ধারণা গরু-ছাগল চুরি এবং বাচ্চাদের তুলে নিয়ে যাওয়ার পেছনে মানুষের হাত আছে। আজ রাতে পাহারার ব্যবস্থা করব। আমাদের জানোয়ারগুলোও নিতে আসতে পারে। গরু-ছাগলের চেয়ে দাম অনেক বেশি ওগুলোর।
দলের সবচেয়ে বিশ্বাসী দু-জন লোক আকামি আর মুংগাকে পাহারায় নিয়োজিত করল কিশোর।
আমি জানি তোমরা খুব ক্লান্ত, ওদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে বলল সে। সারাটা দিন কঠোর পরিশ্রম করেছ। কিন্তু জানোয়ারগুলো চুরি হয়ে গেলে এই পরিশ্রমের কোন অর্থ থাকবে না। পালা করে পাহারা দেবে তোমরা। একজন জেগে থাকলে আরেকজন ঘুমাবে।
কিশোরের কথায় প্রতিবাদ করল না ওরা।
মুংগা বলল, ভাববেন না বাওয়ানা। আমাদের অসুবিধে হবে না। আমরা বেঁচে থাকতে জানোয়ার চুরি করতে পারবে না কেউ।
চিন্তিত ভঙ্গিতে জানোয়ারের খাঁচাগুলোর দিকে তাকাল কিশোর। অগ্নিকুণ্ডের আলোয় খাঁচার জানোয়ারগুলো স্পষ্ট চোখে পড়ে না। সাবধানে থাকতে হবে, নিজেকে বোঝাল সে।
মুসা দাঁড়িয়ে আছে হাতির বাচ্চার সামনে। আদর করে ওটার নাম রেখেছে খুদে দানব। কিছুতেই ভেতরে থাকতে চাইছে না ওটা, শিকের ফাঁক দিয়ে শুড় বের করে দিয়ে ওর হাত জড়িয়ে ধরে টানছে, আর হাতির ভাষায় মানব শিশুর মত আবদার করছে বের করে দেয়ার জন্যে।
হেসে তার শুঁড়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল মুসা। বলল, রাতে আর কোথায় রাখব তোকে, বল? এখানেই আরাম। আমি তো কাছেই থাকব, তুই ডাকলেই শুনতে পাব। থাক, হ্যাঁ? লক্ষ্মী ছেলে।
কিন্তু লক্ষ্মী হওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই খুদে দানবের। বেরোতে পারলে খুশি।
সারাদিন প্রচুর খাটাখাটনি গেছে। তাই তাঁবুতে ঢুকে শোয়র সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল মুসা। কিশোরেরও সময় লাগল না ঘুমাতে।