সর্দার হিবা বলল, হাতি মারতে এসেছ তোমরা। আমরা তোমাদের সাহায্য করব।
পাহাড়ের সমান হাতি মারতে সাহায্য করবে এই বানরের সমান মানুষ!-হাসি পেল কিশোরের। তবে হাসল না। বলল, তাহলে তো উপকারই হয়। অবশ্য একটা ভুল করছেন, হাতি মারতে নয়, হাতি ধরতে এসেছি আমরা।
ওই একই কথা হলো, বিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল হিবা। ধরার পরই তো মারা। মাংস না খেয়ে জ্যান্ত হাতি কেন ধরে নিয়ে যাবে বিদেশীরা, এটা বুঝবে না সে। তাকে বোঝানোর চেষ্টাও করল না কিশোর। ধরতে সাহায্য করলেই হয়। পরের কথা পরে।
কিশোর কি ভাবছে, আন্দাজ করে ওগারো বলল, পিগমিরা অনেক বড় হাতি শিকারি। আমরা, উয়াটুসিরা কাউকে ভয় পাই না, অথচ হাতি মারার সাহস নেই। কিন্তু পিগমিদের আছে। ওরা আমাদের চেয়েও সাহসী। তাদের জাদুর আলাদা। ক্ষমতা আছে। আমি এখনও জানি না, হাতি ধরতে পারবে কিনা তোমরা, কিন্তু যদি পারো, এই পিগমিদের সাহায্যেই পারবে।
মাথা নুইয়ে সর্দারের কথায় শ্রদ্ধা জানাল কালো বামন, বলল, হাতি ধরতে বিদেশীদেরকে সব রকম সাহায্য করব আমরা।
আশ্বাস পাওয়া গেছে। একজন কুলিকে সঙ্গে দিয়ে গাঁয়ের একজন লোক পাঠিয়ে দিল ওগারো, পাহাড়ের গোড়ায় রেখে আসা কিশোরদের বাকি দলটাকে খবর দেয়ার জন্যে।
চোদ্দটা ট্রাক, লরি, জীপ আর ল্যান্ডরোভারের সারি এসে ঢুকল গায়ের পাশের খোলা জায়গায়। ক্যাম্প করার ব্যবস্থা হলো ওখানে।
উয়াটুসিদের বড় বড় শিংওয়ালা গরুগুলো ঘাস খেতে খেতে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখতে লাগল একদল আজব মানুষকে।
তাঁবু খাটানো দেখতে এসেছে গাঁয়ের ছেলেমেয়েরাও। তাদের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল বছর তেরো বয়েসের একটা ছেলে। গায়ের রঙ উজ্জ্বল তামাটে। সুন্দর চোখ, মুখে হাসি। ভাবভঙ্গিতে বোঝা গেল, কথা বলতে চায়।
ছেলেটাকে পছন্দ হয়ে গেল মুসার। জিজ্ঞেস করল, তুমি ইংরেজি জানো?
জানি। তবে বাবার মত বলতে পারি না।
দ্রুত তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল মুসার। জানল, ছেলেটার নাম আউরো। সর্দার ওগারোর ছেলে সে।
চমৎকার একটা হ্রদ আছে এখানে। দুপুরের পর সেটা দেখিয়ে আউরোকে জিজ্ঞেস করল মুসা, মাছ আছে এখানে?
অভাব নেই, আউরো বলল। মাছ ধরতে যেতে চাও?
রাজি হয়ে গেল মুসা।
দৌড়ে গিয়ে বাবার কুঁড়ে থেকে পেপিরাস-আঁশের সুতোয় তৈরি দুটো ছিপ নিয়ে এল আউরো। সুতোর মাথায় কোনও প্রাণীর হাড় দিয়ে বানানো দুটো বঁড়শি বাধা। বুনো শুয়োরের চোয়ালের হাড়ে তৈরি একটা বেলচা জাতীয় জিনিসও আনল।
এটা কি জন্যে? জানতে চাইল মুসা।
কেচো তোলার জন্যে।
এক জায়গায় ভেজা নরম মাটি খুঁড়তে শুরু করল আউরো।
দুটো কেঁচো হলেই চলবে আমাদের, দুটো বঁড়শির দিকে তাকিয়ে বলল মুসা। চন্দ্ৰপাহাড়ের কেঁচোর আকারের কথা ভুলে গিয়েছিল।
অবাক হলো আউরো। দুটো কেন?
দুই ছিপের জন্যে দুটো।
একটাই তো একশো বার গাঁথতে পারবে।
কথাটা বুঝল না মুসা।
ইঞ্চি ছয়েক খোঁড়ার পরই আচমকা গর্তের তলার মাটি খুঁড়ে ছিটকে বেরোল একটা বাদামী মাথা।
সাবধান, সাপ! ঝট করে পেছনে সরে গেল মুসা।
সাপ না।
মাথার পেছনে একটু নিচে যেখানে ঘাড় থাকার কথা সেখানটা চেপে ধরল আউরো। খুঁড়েই চলল মাটি, যতক্ষণ না টেনে বের করে আনতে পারল জীবটাকে। তারপর হাত লম্বা করে তুলে ধরল।
পিগমির সমান লম্বা জীবটা, মুসার কব্জির মত মোটা। মাথাটা বাদামী, শরীরটা আগুনে-লাল। হাঁ করে রেখেছে কুৎসিত মুখ। এ ছাড়া চেহারায় আর কোন বৈশিষ্ট্য নেই।
দূরে দাঁড়িয়ে ছিল কিশোর। দেখতে এগোল।
চোখও নেই, মুসা বলল, কানও নেই।
আমাদের দেশের সাধারণ কেঁচোর মতই, কিশোর বলল। কানে শোনে না, গন্ধ পায় না, স্বাদ বোঝে না। তবে অল্প অল্প দেখতে পায়।
চোখ ছাড়া কি দিয়ে দেখে?
দেখে বলা যাবে না। খুদে খুদে ইন্দ্রিয় আছে এটার, এর সাহায্যে আলো আর অন্ধকারের পার্থক্য বোঝে। দিনের বেলা মাটির নিচে থাকে, রাতে বেরোয়। তখন টর্চের আলো গায়ে ফেললেই তাড়াতাড়ি আবার গিয়ে মাটির নিচে সেঁধোবে।
দানবীয় কেঁচোর শরীরের নিচের দিকে দু-পাশে এক ধরনের খোঁচা খোঁচা জিনিস আছে।
এগুলো দিয়ে কি হয়? জিজ্ঞেস করল মুসা।
এগুলো মাটির নিচে সুড়ঙ্গ করে এগোতে সাহায্য করে কেঁচোকে।
কিন্তু সুড়ঙ্গই বা করে কি করে? খুঁড়ে ফেলা মাটি যায় কোথায়?
সেটাই তো এক বিস্ময়। শরীরের ভেতর দিয়ে পার হয়ে যায় ওই মাটি। খোঁড়া মাটি গিলে ফেলে কেঁচো, সেগুলো আবার বের করে দেয় পেছনের একটা ফুটো দিয়ে। ফলে শরীরটা এগিয়ে গেলেও মাটিতে কোন সুড়ঙ্গ রয়ে যায় না, বের হওয়া মাটিতেই ভরে যায় খোঁড়া অংশটা।
আচ্ছা, এই কেঁচোটা পুরুষ না মেয়ে?
মেয়েও, পুরুষও।
তারমানে উভয়লিঙ্গ! বাপরে বাপ! একটা সাধারণ কেঁচোর মধ্যে এত কারিগরি!
এখন বুঝলে তো, কেঁচোও সাধারণ কোন প্রাণী নয়।
হ্রদের পাড়ে একটা কলাগাছের ভেলা বাঁধা আছে। মুসাকে নিয়ে সেটাতে চড়ল আউরো। বেয়ে নিয়ে এল বেশি পানিতে। মাথা কেটে ফেলে আগেই কেঁচোটাকে মেরে ফেলেছে সে। এখন সেটাকে কেটে দুই টুকরো করে বঁড়শিতে গাঁথল।
পানিতে বঁড়শি ফেলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টান পড়ল সুতোয়। টেনে তুলল মুসা। ক্যাটফিশের মত একটা মাছ, তবে আরও অনেক বড়।
মুসার পর পরই আউরোও ধরে ফেলল আরেকটা।