সামনে হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল জঙ্গল। ওখানে ঘাসের রাজত্ব। আর ঘাসও বটে! মানুষের মাথা ছাড়িয়ে যায়।
তারপর আবার বদলে গেল দৃশ্য। কলাবাগানে ঢুকল ওরা। কলাগাছ না বলে তালগাছ বলাই ভাল, আর কলাগুলোকে কলা না বলে শসা। এত বড়।
মাটিতে পড়ে থাকা একটা কলা তুলে নিয়ে ছুরি দিয়ে কেটে অবাক হয়ে গেল মুসা। কিছু নেই ভেতরে, কেবল বড় বড় বীচি। শসটা কি হয়েছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, বেশিদিন পড়ে থাকলে খোসার ভেতরেই শাঁসটা নষ্ট হয়ে যায়।
আরও এগোতে মানুষের কলরব শোনা গেল। বোঝা গেল, গায়ের কাছে চলে এসেছে।
গাঁয়ে ঢোকার মুখে পথের পাশে একটা বিরাট ঘর। ফুলে ফুলে ঢাকা। ভেতরে তাকে তাকে সাজানো রয়েছে ফল, শস্য, আর মাংস।
এটা কি? সর্দারকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
দুষ্ট প্রেতের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে এই ব্যবস্থা। খাইয়ে-দাইয়ে ওদের। পেট ভরিয়ে রাখতে পারলে মানুষের দিকে আর নজর দেবে না।
কাজ হয় এতে?
সব সময় হয় না, স্বীকার করল সর্দার। এত কিছু দেয়ার পরেও গাঁয়ে ঢোকে। নিয়ে আসে রোগ-শোক, আমাদের গরু ছাগল চুরি করে নিয়ে যায়। এ সব করতে করতে সাহস এতটাই বেড়ে গেছে, কিছুদিন ধরে আমাদের ছেলেমেয়েদেরও ধরে নিতে আরম্ভ করেছে। রাতের বেলা রহস্যজনক ভাবে হারিয়ে যায় ছেলেমেয়েগুলো। পরদিন সকালে পাহাড়, জঙ্গল আঁতিপাতি করে খুঁজেও ওদের কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না। একবার গেলে ফেরে না আর কখনও।
বিষণ্ণ দেখাল সর্দারকে। আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী জাদুও এখানে বিফল হয়েছে। কি করব বুঝতে পারি না। যাই হোক, আমাদের যন্ত্রণার কথা বলে। তোমাদের মন খারাপ করতে চাই না। এসো, আমাদের গায়ে স্বাগতম।
আফ্রিকার অন্যান্য গাঁয়ের চেয়ে ওগারোর গ্রাম অনেক বেশি সুন্দর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে করে রাখা হয়েছে। শক্ত, মোটা শ্যাওলা দিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছে কুঁড়েগুলোর; কাঠামোে আর খুঁটি বাঁশের তৈরি। বাঁধা হয়েছে লিয়ানা লতা দিয়ে। পেপিরাসের উঁটি দিয়ে চাল ছাওয়া হয়েছে-প্রাচীন মিশরীয়রা যে জিনিস দিয়ে কাগজ বানাত, সেই একই জিনিস। তালপাতা দিয়ে তৈরি চালার চেয়ে এ চালা অনেক বেশি টেকসই। চালার নিচের দিকটা অনেকখানি করে বাড়িয়ে রাখা হয়েছে, যাতে বেড়াগুলোতে বৃষ্টির পানি না লাগতে পারে।
কিন্তু ঘরবাড়ির চেয়ে গাঁয়ের মানুষের প্রতিই বেশি কৌতূহল আর আগ্রহ কিশোর-মুসার। সাত ফুটের বেশি লম্বা নারী-পুরুষ এগিয়ে এল তাদের সঙ্গে মমালাকাত করার জন্যে। গায়ের সাদা চাদরের কারণে মার্বেলের স্তম্ভ বলে মনে হচ্ছে ওদেরকে। মেহমানদের ঘিরে ফেলল ওরা।
নিজের ভাষায় আগন্তকদের পরিচয় গ্রামবাসীদের জানাল সর্দার।
ওগারোর মতই সহজ-সরল গ্রামের মানুষগুলো। হাসিমুখে মেহমানদের অভ্যর্থনা করল।
.
০৪.
একটা ব্যাপার লক্ষ করল কিশোর, গায়ের সব মানুষ সাত ফুট উঁচু নয়।
ওদের চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে অনেক খুদে খুদে মানুষ, যাদের গায়ে সাদা চাদর নেই, শুধু কোমরের কাছে একটুকরো গাছের বাকল বাধা। ওটাই ওদের নেংটি। উয়াটুসিদের মত তামাটে নয় এদের গায়ের রঙ, কুচকুচে কালো।
সবচেয়ে জিব ব্যাপারটা হলো, ওদের উচ্চতা। তিন থেকে চার ফুট, তার বেশি নয়। অথচ সবাই প্রাপ্তবয়স্ক।
এ তো মনে হচ্ছে গালিভারের গল্পের দেশে চলে এলাম! অবাক হয়ে বলল মুসা। ব্ৰবডিংনাগ আর লিলিপুট, দু-জাতের একসঙ্গে বসবাস। একদল দৈত্য, আরেক দল বামন। কি করে সম্ভব হলো এটা?
বামনরা হলো পিগমি, কিশোর বলল। কঙ্গোর এই এলাকার অনেক বিস্ময়ের একটা এই বিস্ময়। একই জায়গায় যেমন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানুষের বাস, পাশাপাশি বাস পৃথিবীর সবচেয়ে খুদে মানুষদেরও-উয়াটুসি এবং পিগমি। উয়াটুসিদের কুঁড়ের পেছনে ওই যে ওইখানে মৌচাকের মত খুপরিশুলো দেখছ, ওগুলো পিগমিদের বাড়িঘর।
ওদের কথা শুনছিল সর্দার। বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। গাঁয়ের একটা অংশে পিগমিরা থাকে। ওরা আমাদের চাকর। তবে ওদেরকে অসম্মান কিংবা অপমান করার কোন কারণ নেই। ওদের সর্দারের সঙ্গে দেখা হয়েছে? ওর নাম হিব।
নাম ধরে ডাকতেই বড় পুতুলের আকারের একজন মানুষ বেরিয়ে এল ভিড়ের মধ্যে থেকে। আন্তরিক ভঙ্গিতে হাত মেলাল কিশোর-মুসার সঙ্গে, অবশ্যই আফ্রিকান কায়দায়। শরীরের তুলনায় মাথাটা অস্বাভাবিক বড়। চোখের কোণে আর গলার ভাঁজ দেখেই বোঝা যায়, অনেক বয়েস তার, বুড়ো মানুষ।
উচ্চতার এই তারতম্য অদ্ভুত লাগছে কিশোরের কাছে।
কালো বনের কালো লোকটার চেহারার সঙ্গে মানুষের চেয়ে শিম্পাঞ্জীর মিলই বেশি। কিশোরকে আরও অবাক করে দিয়ে ইংরেজিতে কথা বলে উঠল সে, তোমাদের সাহায্য করতে পারলে খুশি হব আমরা। তোমাদের দেশের লোকেরা কথা-বলা-ছবি তুলতে এসেছিল আমাদের দেশে। তখন তোমাদের ভাষা শিখেছি।
তোমাদের দেশ বলতে আমেরিকানদের বোঝাচ্ছে হিবা। তার জানা থাকার কথা নয়, আমেরিকা থেকে এলেও কিশোর আমেরিকান নয়, বাংলাদেশী। আর মুসা তো তাদেরই দেশী, আফ্রিকান। সেসব ব্যাখ্যা করতে গেলে বাংলাদেশ আর আমেরিকা সম্পর্কে অনেক জ্ঞান দিতে হবে লোকটাকে। অত কথার মধ্যে গেল না কিশোর। হেসে বলল, আপনাদের ভাষাও যদি আমি এমন করে বলতে পারতাম, খুব ভাল হত।