তা বলছি না। বিদেশী মানুষের জাদু আমাদের জাদুর চেয়ে অন্য রকমও হতে পারে। আমি বলছি, হাতি ধরায় আমাকে সাহায্য করার অনুরোধ কোরো না। উয়াটুসিরা অসহায়।
বেশ, হাতি ধরতে না হয় না-ই গেলেন। কিন্তু আরও সাহায্য করতে পারেন আমাদের। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে গুজগুজ, ফিসফাস করছে কুলিরা। এগোতে সাহস পাচ্ছে না ওরা। একটু বোঝাবেন ওদের? বলবেন, সামনে কোন বিপদ নেই?
কিন্তু বিপদ নেই এ কথা তো বলতে পারি না। হাতির পেছনে লাগলে অবশ্যই আছে। সোজা গিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢুকবে। এগিয়ে এসে পিষে মারবে তোমাকে পর্বত। ওগুলোর মধ্যে যে দুষ্ট প্রেতেরা বাস করে, হাত তুলে আশপাশের দানবীয় উদ্ভিদগুলোকে দেখাল সর্দার, ওরা চোখের পলকে বুনো জানোয়ার হয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলবে তোমাদের।
ওগারোর কুসংস্কার দেখে মনে মনে হাসল কিশোর, তবে মুখে সেটা প্রকাশ করল না। বলল, সেই ভাবনা আমাদের। বেশ, সামনে বিপদ নেই, একথাও নাহয় না বললেন। সামনে যে তাঁবু ফেলার নিরাপদ জায়গা আছে এটা বলতে নিশ্চয় আপত্তি নেই?।
না, তা নেই, এ কথা খুশি হয়েই বলতে পারি। আমার গায়েই থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি তোমাদের। বেশি দূরে নয়। তোমার আর সব লোক কোথায়? এখানে তো মাত্র বারোজন?
এটা স্কাউটিং পার্টি, কিশোর জানাল। আগে আগে হেঁটে চলে এসেছি আমরা, পথঘাট চিনে নেয়ার জন্যে। মোটর চলার রাস্তা আছে কিনা দেখে গিয়ে ওদেরকে খবর দিলে ওরা আসবে। জীপ আর ট্রাক নিয়ে পাহাড়ের গোড়ায় অপেক্ষা করছে ওরা। খবর পেলেই রওনা হবে। এখন আপনি আমাদের সাহায্য না করলে সব ভজকট হয়ে যাবে।
দেখি, কি করতে পারি, বলে ভয়ে কুঁকড়ে থাকা কুলিদের দিকে এগোল ওগারো।
মন দিয়ে সর্দারের কথা শুনল লোকগুলো। তার গায়ে ওদেরকে থাকতে দেয়া হবে জেনে মুহূর্তে খুশি হয়ে উঠল ওরা, ভয় কেটে গিয়ে উজ্জ্বল হলো চোখমুখ। আনন্দে হুল্লোড় করে উঠল।
আবার এগিয়ে চলল দলটা। নানা রকম দানবীয় উদ্ভিদের অভাব নেই পথের পাশে, কিন্তু এখন ভয় কেটে গেছে কুলিদের। তবে গাছগুলোর কাছ থেকে দূরে থাকছে যতটা সম্ভব। মানুষ সমান উঁচু বিছুটির রোয়াগুলো বড় বড় কাঁটার মত, সুচের মত তীক্ষ্ণ। তাড়াহুড়ো করে এগোতে গিয়ে এই কাঁটার খোঁচা খেলো মুসা। বুশ জ্যাকেট আর সাফারি ট্রাউজারের মত ভারি কাপড়ও অতি সহজেই ভেদ করে চামড়ায় ফুটে গেল কাঁটা। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল সে।
পথের ওপর পড়ে থাকা বিছুটির একটা ভাঙা ডাল তুলে নিয়ে কাঁটাগুলো পরীক্ষা করে কিশোর বলল, এতে লাগলে গাড়ির চাকাও ফুটো হয়ে যাবে! সাংঘাতিক শক্ত!
এগিয়ে গিয়েছিল সর্দার। গোলমাল কিসের দেখার জন্যে ফিরে এল। মুসার হাতের আঁচড় থেকে রক্ত বেরোতে দেখে আন্দাজ করে ফেলল কি হয়েছে। গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, হবেই। চিতাবাঘের নখ ধারালই হয়।
চিতাবাঘ পেলেন কোথায়? অবাক হয়ে বলল মুসা, এ তো কাটা!
চিতাবাঘ যখন মরে যায়, এই গাছ হয়ে যায়। আবার গাছ মরে গিয়ে চিতাবাঘ হয়।
সর্দারের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। ইংরেজি জানা বুদ্ধিমান একজন মানুষের এরকম অদ্ভুত বিশ্বাস জন্মায় ভাবতে অবাক লাগে। সব গাছপালাই কি নানা রকম জানোয়ার?
না, সব জানোয়ার নয়। কিছু কিছু গাছ আমাদের পূর্বপুরুষদের আত্মা।
তাহলে নিশ্চয় ওসব গাছকে ভয় করার কিছু নেই। আপনার পূর্বপুরুষরা নিশ্চয় সব ভালমানুষ ছিলেন?
তা ছিলেন। ভাল এবং দয়ালু। কিন্তু মরার পর খারাপ হয়ে গেছে। খারাপ এবং নিষ্ঠুর।
কেন এ রকম হলো?
কারণ ওদেরকে খাবার দিই না আমরা। দিতে পারি না। অনেক বেশি লোক। কত দেব? যাকে দিতে পারি না, সে-ই আমাদের শত্রু হয়ে যায়, রেগে গিয়ে ক্ষতি করার চেষ্টা করে। ধারাল নখওয়ালা জানোয়ার হয়ে ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে থাকে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে, বিষাক্ত রস খাইয়ে আমাদের অসুস্থ করে ফেলে, গায়ের ওপর পড়ে পিষে মারে।
সর্দারের কথাকে সত্য প্রমাণ করার জন্যেই যেন গাছ থেকে ঝরে পড়ল একটা বিশাল লবেলিয়া ফুল। লাফ দিয়ে সরে গেল নিচে যে লোকটা ছিল সে। গায়ে পড়লে মরত।
ফুলটা ভাল করে দেখল কিশোর। নীল রঙের পাপড়িগুলো যেন একেকটা ইস্পাতের পাত। দশ-বারো বছরের একটা ছেলের সমান বড় ফুলটা এত ভারি, টেনে তুলতেই কষ্ট হয়।
চমৎকার নমুনা, বলে আকামির দিকে ফিরল কিশোর। দু-জন লোককে আসতে বলো তো, তুলে নিক।
হাত তুলল সর্দার। না না, নিয়ো না, আমার কথা শোনো। থাক এখানেই। এটা সঙ্গে নেয়ার মানে মৃত্যুকে বহন করা। দু-জন মানুষ হারাতে না চাইলে এ কাজ কোরো না।
ফিসফিস করে বন্ধুকে বলল মুসা, লোকটা পাগল। এসো, আমরা দুজনেই বয়ে নিই।
না, মাইন্ড করে বসতে পারে। তাহলে বেকায়দায় পড়ব আমরা। ও এখানকার সর্দার, ভুলে যেয়ো না।
পিপার মত ফুলটাকে ঠেলে রাস্তার ওপর থেকে সরিয়ে দিল কিশোর। থাক এখানে। পরে এসে নেব।
গায়ের দিকে এগোতে এগোতে আরও নানারকম অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল ওদের। মাটিতে চার ফুট উঁচু হয়ে জন্মে থাকা শ্যাওলার পাশাপাশি গাছের গায়ে আঠারো ফুট পুরু হয়ে জন্মেছে আরেক ধরনের শ্যাওলা। ওগুলোর মধ্যে গর্ত করে বাসা বেঁধেছে পেঁচা। কোন কোন জায়গায় এমন করে ঢেকে ফেলেছে, মূল গাছটাকেই আর দেখা যায় না, মনে হয় শ্যাওলার বড় বড় স্তম্ভ। সেইসব স্তম্ভকে আবার ছেয়ে রেখেছে অপূর্ব সব অর্কিড, কি তাদের রঙ-লাল, গোলাপী, নীল, সবুজ! রামধনুর সাতরঙের ছড়াছড়ি এখানে।