তা-ও তো বটে। একমুহূর্ত ভাবল মুসা, লাফ দিয়ে কত ওপরে উঠতে পারবেন আপনি?
কতটা উঠতে বলো?
আবার ভেবে নিল মুসা। কিশোরকে দেখিয়ে বলল, আমার বন্ধুর মাথার ওপর দিয়ে পেরিয়ে যেতে পারবেন?
পরামর্শটা ভাল লাগল না কিশোরের। মুসার দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল, ভাল করে ভেবে দেখো কি বলছ। যদি পার হতে না পারে, লাথি লাগবে আমার মুখে।
লাগবে বলা যায় না, লাগতে পারে, মুচকি হাসল মুসা।
সব শুনতে পেল ওগারো। আরেক কাজ করো বরং। কিশোর, তুমি তোমার বন্ধুকে কাঁধে নিয়ে উঠে যাও। লাফিয়ে দুজনের মাথার ওপর দিয়ে চলে যাব আমি।
হেসে ফেলল কিশোর। এগিয়ে গেল মুসার দিকে। তাকে জব্দ করতে চেয়েছিল মুসা এখন পড়েছে বেকায়দায়।
কি আর করবে মুসা, নিজের ফাঁদে নিজেই পড়েছে। কাঁধ নিচু করে দিল। তার কাঁধে উঠে বসে দুই পা ঝুলিয়ে দিল কিশোর মুসার বুকের ওপর।
কেমন লাগছে? হেসে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
রাগে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে উঠল মুসা।
শব্দ করে হেসে ফেলল কিশোর। তরল স্বরে বলল, মন খারাপ কোরো না। লাথি খেয়ে মরার ভয় পাচ্ছ তো? ভয় নেই, সবাইকে একদিন মরতে হবে-আগে আর পরে। তুমি না থাকলে তোমার জন্যে সত্যি খারাপ লাগবে আমার, মুসা। আহা, এতগুলো বছর একসঙ্গে ছিলাম, কত জ্বালিয়েছ আমাকে।
কিশোরের পা খামচে ধরল মুসা।
আঁউ! করে চিৎকার করে উঠল কিশোর, খামচি দিলে কেন?
যদি পড়ে যাও, সেজন্যে শক্ত করে ধরলাম।
আমি তো তোমার মাথা শক্ত করে ধরে আছি। পড়ব কেন?
হাসল মুসা। বুঝলে না? বুঝিয়ে দিলাম, এখনও মরিনি! জ্বালানো শেষ হয়নি।
গায়ের চাদর খুলে ফেলল ওগারো। তার তামাটে রঙের সুগঠিত শরীরটা দেখতে লাগছে একটা তামার স্তম্ভের মত।
দুই গোয়েন্দা ভাবল, কিছুদূর পিছিয়ে গিয়ে দৌড়ে এসে লাফ দেবে সে, হাই জাম্প যেভাবে দেয়া হয়। কিন্তু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল ওগারো। হঠাৎ করে হাঁটু ভাঁজ করে আবার সোজা করে ফেলল, শূন্যে লাফিয়ে উঠল ঘড়ির মত। মুসার মাথা ছাড়াল পা, তারপর কিশোরের। ওর মনে হলো বিশাল পা দুটো এসে বাডি মারবে মুখে। চোখ বন্ধ করে ফেলল সে।
কিন্তু মাথার ওপর এক ঝলক দমকা বাতাস ছাড়া আর কিছু টের পেল না। চোখ মেলে দেখতে পেল তার পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছে সর্দার। এতবড় একটা পরিশ্রমের পরও সামান্যতম হাঁপাচ্ছে না। চাদরটা তুলে নিয়ে আবার গায়ে পেঁচাল।
আর কিছু করতে হবে? জিজ্ঞেস করল সে।
করলে খুবই উপকার হয়, কিশোর বলল। তবে তার আগে বলে নিই, আমরা কেন এখানে এসেছি। আমরা এসেছি জন্তু-জানোয়ার ধরতে। চিড়িয়াখানা, সার্কাস, ফিল্ম কোম্পানির দরকার হয় এ সব জানোয়র। তাদের কাছে বিক্রি করব। এ ব্যাপারে আপনার সাহায্য দরকার।
জানোয়ার ধরা খুব বিপজ্জনক কাজ। একা করা কঠিন।
একা নই আমরা। তিরিশ জন লোক আছে। সবাই আফ্রিকান। আফ্রিকা চেনে ওরা, কোন্ জানোয়ার কোথায় থাকে, ওদের স্বভাব কেমন, জানে।
মাধা নাড়ল সর্দার। ওরা জানে কেবল খুন করতে। জ্যান্ত ধরতে জানে না।
কিন্তু আমার লোকেরা শিখে ফেলেছে। কয়েক মাস ধরে আমাদের সঙ্গে আছে ওরা। অনেক জানোয়ার ধরেছি-জিরাফ, মোষ, হায়েনা, চিতাবাঘ, বেবুন, জলহস্তী, অজগর সাপ, দাঁতালো শুয়োর, বুশ-বেবি, হানি ব্যাজার, আরও অনেক কিছু।
ও, তাহলে তো অনেকই এগিয়েছ। নিয়েই ফেলেছ সব।
না, এখনও বাকি আছে। সবচেয়ে বড়টাকেই ধরা হয়নি এখনও।
হাতির কথা বলছ?
হ্যাঁ। সাধারণ হাতি আগেই ধরতে পারতাম। তবে আমরা চাই চন্দ্ৰপাহাড়ের হাতি। বাচ্চা একটা হাতি অবশ্য চলে এসেছে আমাদের সঙ্গে। ওটার মা-কে মেরে ফেলেছে পোচাররা। হাতিটাকে বাঁচাতে গিয়ে পোচারদের মার খেয়ে আহত হয়েছে আমার আরেক বন্ধু রবিন মিলফোর্ড। অবস্থা এতটাই খারাপ, ফিরতি প্লেনেই দেশে, অর্থাৎ আমেরিকায় পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি তাকে। আমার বন্ধু মুসা মরা হাতির বাচ্চাটাকে সান্তনা দিতে গিয়েছিল। বাচ্চাটা চলে এসেছে তার সঙ্গে। নেওটা হয়ে গেছে। খাঁচার বাইরে থাকলে মুসাকে ছেড়ে এক পা নড়বে না।
হাসল সর্দার। কিন্তু এখানকার হাতি তো ধরতে পারবে না।
কেন পারব না?
এগুলো অনেক বড়, অনেক শক্তি গায়ে। চন্দ্ৰপাহাড়ের হাতির মত শক্তিশালী আর কোন জানোয়ার পৃথিবীতে নেই। কারণ ওরা পাহাড়।
এই প্রথম লোকটার চোখে ভয় দেখতে পেল কিশোর। জিজ্ঞেস করল, পাহাড়ের মত বড় বলতে চাচ্ছেন তো?
না, আসল পাহাড়ই বলতে চাইছি।
সচল কুয়াশায় ডুবছে-ভাসছে যেন পেছনের আর আশপাশের পাহাড়গুলো।
সাধারণ জায়গা মনে কোরো না এটাকে, সর্দার বলল, জাদুর ছড়াছড়ি এখানে। চেহারা দেখে এখানে জিনিস চেনা মুশকিল। খালি চোখে যা দেখা যায়, আসলে সেটা সে-জিনিস নয়, অন্য কিছু। মস্ত ধোকা। আমাকে পাগল ভাবছ তো? বোকা ভাবছ? কোনটাই আমি নই। আমাদের ওঝারাও বোকা নয়। তাদের কথা বিশ্বাস করি আমরা। এই ভূমি হাতিদের পবিত্র স্থান। কুয়াশায় ঢেকে দেয় পাহাড়-পর্বত, হঠাৎ দেখবে একটা হাতি দাঁড়িয়ে আছে তোমার সামনে। পরক্ষণেই নেই, সেখানে আবার পাহাড়। দেখলে কে অবিশ্বাস করবে হাতি আর পাহাড় এক নয়? সুতরাং বুঝতেই পারছ, হাতির সঙ্গে লাগতে যাওয়া আর পর্বতের বিরুদ্ধে লড়াই করা এখানে একই কথা।
আজব বিশ্বাস, ভাবল কিশোর। অনবরত পাক খেয়ে ঘুরে মরছে যেন কুয়াশার স্তর, তার মধ্যে দানবীয় ফুল, অজগর সাপের মত মোটা মোটা লতাগুলোকে কেমন অপার্থিব লাগছে। আপনি বলতে চাইছেন হাতি যদি ধরেও ফেলি, ওটা পরে পাহাড় হয়ে যাবে?