আগের নামটাই ভাল ছিল। শুনতে একটু কেমন কেমন লাগে বটে, কিন্তু এক ধরনের রোমান্টিকতা আছে। আমরা আরও সহজ করে চাঁদের পাহাড়ই বলব, কি বলো?
অসুবিধে নেই।
এহেন রহস্যময় চাঁদের পাহাড়ের আরও গভীরে যে যেতে রাজি হবে না নিগ্রো কুলিরা, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, বিশেষ করে গুলি খেয়ে মরে যাওয়া হাতি জ্যান্ত হয়ে চলে যাওয়ার পর। হাতির মাথায় কোথায় গুলি লাগাতে হয়, ওরাও জানে না। কারণ বন্দুক দিয়ে শিকার করেনি ওরা, করেছে বর্শা আর তীর ধনুক দিয়ে।
অধৈর্য হয়ে বলল মুসা, সারাদিন এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব নাকি? যেতে বলছ না কেন? ধমক লাগালেই হয়।
মাথা নাড়ল কিশোর, লাভ হবে না। ধমক দিয়ে কোন আফ্রিকানকে কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না, নিজের ইচ্ছেয় যদি না যায়। যেতে বাধ্য করলে বিপদে ফেলে দেবে। সাংঘাতিক কুসংস্কার এদের, বনের বাঘ-সিংহকে পরোয়া করে না, কিন্তু ভূতের ভয়ে কুঁকড়ে যায়। এদের বেশির ভাগেরই ধারণা প্রতিটি বড় ঝোঁপ, প্রতিটি পাথর একটা করে ভূতের বাসা। যত বড় ঝোঁপ হবে, ভূতটাও হবে তত বড়। সময় দিতে হবে ওদের, বুঝতে দিতে হবে, দানবীয় এই গাছপালা আসলে কোন ক্ষতি করতে পারে না।
সময় কাটছে। কুলিদের বোঝানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করল আকামি। অনেকক্ষণ পর যখন দেখল ওরা, এই দানব বনের ভূত তাদের কোন ক্ষতি করছে না, তখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও আরও কিছুদূর এগোতে রাজি হলো।
একটা বুট নষ্ট করে ফেলেছে হাতি। আরেকটা পায়ে রেখে কোন লাভ নেই। সেটাও খুলে ফেলে দিয়ে আরেক জোড়া বুট পরে নিল কিশোর।
যেটা ফেলে দিল, মহানন্দে সেটা তুলে নিল হামবি নামের এক কুলি সর্দার। পায়ে টায়ার কেটে তৈরি একজোড়া স্যান্ডেল। সেগুলো খুলে রেখে বুটটা পরে ফেলল সে। আরেক পায়ে জুতোর মত করে পাতা জড়িয়ে লতা দিয়ে বেঁধে নিয়ে গর্বিত দৃষ্টিতে তাকাল সঙ্গী কুলিদের দিকে। এত সুন্দর জুতো জীবনে আর পরেনি সে।
.
০৩.
লোকে কথায় বলে-গর্বে মাটিতে পা পরে না। কিন্তু নতুন জুতোর গর্বে আরও বেশি করে পা ফেলতে লাগল হামবি, নতুন শক্তি দিল যেন বিচিত্র জুতোজোড়া। হাসতে হাসতে পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগল সে। কিন্তু আচমকা থমকে দাঁড়াল, হাসি মুছে গেছে মুখ থেকে। পাহাড়ী পথ বেয়ে একটা ভূতকে নেমে আসতে দেখেছে।
কয়াশায় জড়িয়ে থাকায় ভূতটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। ভূত মনে হওয়ার কারণ, মানুষের মত দেখতে হলেও ওটা বেজায় লম্বা। তার ধারণা মানুষ এত লম্বা হতে পারে না।
পেছনের কুলিরাও দেখে ফেলল ভূতটাকে। আতঙ্কে, উত্তেজনায় একে অন্যের গায়ে গুতো দিয়ে কলরব শুরু করে দিল ওরা। দু-একজন ঘুরে দৌড় দেয়ারও চেষ্টা করল, ধরে ফেলল আকামি।
দমকা বাতাসে সরে গেল কুয়াশা। স্পষ্ট দেখা গেল এখন মানুষটাকে, ভূত নয়। কিন্তু তবু কুলিদের কারও বিশ্বাস হতে চাইল না।
ওরা যে অঞ্চল থেকে এসেছে, সেখানকার মানুষ পাঁচ ফুটের ওপরে কয়েক ইঞ্চির বেশি লম্বা হয় না। পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা মানুষ উয়াটুসিদের কখনও দেখেনি ওরা, যারা সাত ফুটের বেশি লম্বা হয়।
উয়াটুসিরা নিগ্রো নয়, সাদা মানুষও নয়, ওদের চামড়া উজ্জ্বল তামাটে রঙের। মাথা সোজা করে চলার স্বভাব, চলেও দ্রুতগতিতে, যেন দমকা বাতাস। ভাল নাচতে পারে, লাফ দিয়ে উঠতে পারে অনেক উঁচুতে।
কিং সলোমনস মাইনস ছবি থেকে উঠে এসেছে দেখি! বিড়বিড় করল কিশোর।
মাথা ঝাঁকাল মুসা। ফিল্মটা সে-ও দেখেছে। ওই ছবিতে উয়াটুসিদের একটা চমৎকার দৃশ্য চিত্রায়িত করা হয়েছে।
আঁকাবাঁকা পথ ধরে নেমে আসা লোকটার একটা সাদা চাদরে মোড়া, হাতে লম্বা লাঠি। বিদেশীদের দেখে নিশ্চয় অবাক হয়েছে, কিন্তু ভয় পেল না। নিজের চেয়ে আকারে ছোট মানুষকে ভয় করে না উয়াটুসিরা।
এগিয়ে আসছে লোকটা। পাশ কাটানোর সময় সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম জানাল।
আকামি, কিশোর বলল, ওকে থামতে বলো। ওর সঙ্গে কথা বলব।
সব আফ্রিকান গোত্রেরই মোটামুটি নিজস্ব একটা ভাষা থাকে, উয়াটুসিদেরও আছে। সেটা জানে না আকামি। সুতরাং সোয়াহিলি ভাষায় কথা বলল সে-আফ্রিকার অনেক জায়গার লোকেই এই ভাষাটা বোঝে।
বুঝল লম্বা লোকটা। মাথা ঝাঁকাল। তবে সোয়াহিলিতে না বলে কিশোরের দিকে ফিরে ইংরেজিতে বলল, কি করতে পারি, বলো?
অবাক হয়ে গেল কিশোর, আপনি ইংরেজি জানেন!
হাসি ফুটল তামাটে মুখটায়। এত বছর ধরে ইংরেজরা মাতব্বরি করল আমাদের ওপর, ভাষাটা জানব না? তবে আমি শিখেছি সিনেমায় কাজ করার সময়।
সিনেমা?
হ্যাঁ, একটা ছবিতে কাজ করতে হয়েছে আমাকে। অভিনয়।
নেচেছেন?
নেচেছি, লাফিয়েছি, কথাও বলেছি।
লাফিয়েছেন? কথাটা ধরল মুসা। তারমানে ওটা সাংঘাতিক লাফ, নইলে সিনেমায় নিতে যাবে কেন?
তা বলতে পারো।
আপনার নামটাই কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়নি এখনও, কিশোর বলল।
আমার নাম ওগারো। আমি একটা গায়ের মোড়ল।
ও, তারমানে সাধারণ লোক নয়। ইংরেজি জানে, গায়ের সর্দার…নিজের, মুসার আর আকামির পরিচয় দিল কিশোর।
মুসা বলে বসল, পরিচয় তো হলো, এবার আপনার লাফ দেখাবেন? শুনেছি উয়াটুসিরা অনেক উঁচুতে উঠতে পারে লাফ দিয়ে, কথাটা সত্যি?
ওগারো হাসল, সত্যি না হলে কি আর সিনেমার জন্যে ছবি তোলে?