মাথার কাছে একটা বড় ফুটো। সেটা দেখিয়ে আকামি জিজ্ঞেস করল মুসাকে, এখানে গুলি করেছিলে?
মাথা ঝাঁকাল মুসা।
চট করে কিশোরের দিকে তাকাল আকামি। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল দু জনের। তাড়াতাড়ি একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল সে-শিকলটা তুলে এনে ফাস পরিয়ে দিল হাতির পায়ে।
অবাক লাগল মুসার। জিজ্ঞেস করল, মরা হাতিকে বাঁধছ কেন?
মরেনি, জবাব দিল কিশোর।
মানে? মগজে বুলেট খেয়ে পড়ে গেল, মরেনি মানে?
হাতি শিকারে তোমার অভিজ্ঞতা নেই তো, তাই বলছো। হাতির মাথার সামনের দিকটায় শুধুই হাড়, পুরু শক্ত হাড্ডি। এই হাড়ে ঢুকে আটকে যায় বুলেট, মগজ পর্যন্ত যেতে পারে না। মগজ অনেক পেছনে, দুই চোখের মাঝামাঝি জায়গায়। গুলির আঘাতে কেবল বেহুশ হয়েছে ওটা, শীঘ্রি জেগে যাবে।
হা হয়ে গেল মুসা। কথাটা জানে না বলে নিজের ওপর রাগ হলো, তবে খুশিও হলো, প্রাণীটাকে খুন করতে হয়নি বলে।
কিশোরের কথাই ঠিক।
গলার গভীর থেকে ভারি একটা ঘড়ঘড়ে শব্দ উঠে এল হাতিটার। তারপর চাপা গোঙানি। কাছাকাছি ছিল যারা, তাড়াতাড়ি সরে গেল।
চোখ মিটমিট করল হাতিটা। শুড় নাড়ল। তারপর বিকট চিৎকার করে আবার খাড়া হয়ে উঠল। তাড়া করতে গেল কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজন কুলিকে।
কিন্তু পায়ে আটকানো শিকল ঠেকিয়ে দিল তাকে।
পিছিয়ে গিয়ে, আরেকবার চিৎকার করে আবারও তেড়ে গেল হাতি। সাংঘাতিক টান লাগল শিকলে। আর তাকে আটকাতে পারল না শিকল, মট করে ছিঁড়ে গেল।
উধাও হয়ে গেছে কুলিরা।
কাউকে না পেয়ে মোপানি গাছটার দিকে তাকাল সে। কেউ নেই দেখে নিরাশ হয়েই যেন আরেকবার চিৎকার করে, রওনা হয়ে গেল বনের দিকে। পাথরে ঘষা লেগে লেগে শিকলের শব্দ উঠছে ঝনঝন, ঝনঝন। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সেই শব্দ।
খানিক দূরে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে মুসা আর কিশোর।
স্তব্ধ হয়ে গেছে দু-জনে। এত শক্ত শিকল এমন করে ছিঁড়ে ফেলতে পারবে হাতিটা, কল্পনা করেনি।
জোর গুঞ্জন করে উঠল কুলিরা।
.
০২.
কান পেতে শুনছে সবাই। হাতির চিৎকার থেমে যেতে হঠাৎ বড় বেশি নীরব মনে হলো বনটাকে। কেমন যেন গা শিউরানো পরিবেশ। মনে হচ্ছে, এর চেয়ে হাতির চিৎকারও ভাল ছিল।
চলো, এগোই, কিশোর বলল।
আকামি জানাল, কুলিরা আর এগোতে চায় না।
কেন?
ওরা বলছে এটা খারাপ জায়গা। এখানে কিছু ধরতে পারব না আমরা। এখানে মৃত্যু ছাড়া আর কিছু নেই। এ রকম জায়গা নাকি আর কখনও দেখেনি। ওরা।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। সে-ও দেখেনি কখনও। মনে হচ্ছে একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে রয়েছে। আশপাশের দানবদের তুলনায় নিজেকে অতি ক্ষুদ্র লাগছে।
বড় বড় গাছগুলো এমন করে ছেয়ে আছে শ্যাওলায়-দেখে মনে হয় বুড়ো মানুষের দাড়ি। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে দুলছে। ডালে ডালে জড়াজড়ি করে আছে শত শত ফুট লম্বা লতা। যখন তখন নেমে আসছে আকাশের মেঘ, গাছপালা। ভেদ করে মাটি ছুঁয়ে ভেসে যাচ্ছে, যেন শিকার দেখে ছো মারার জন্যে নামছে আকাশচারী দানব।
ঘন হয়ে ঝুলে আছে কুয়াশার মত বাষ্প।
ভাবা যায় ঘরের সমান বড় একেকটা ফুল! ইউরোপ আমেরিকায় হাঁটু সমান উঁচ ফুল দেখেছে সে, কিন্তু এখানে সেই একই জাতের ফুলই চারজন মানুষের সমান উঁচ। আমেরিকায় যে বীজ পাখিতে খায়, সেটা এখানে পাখির চেয়ে বড়। যে সব ফার্ন সাধারণত হাঁটুর চেয়ে উঁচু হয় না, এই চন্দ্ৰপাহাড়ের সেগুলো বড় বড় গাছের সমান। সব কিছুই অস্বাভাবিক বড়।
অদ্ভুত এক জগৎ! শুরুতে তো কিশোর বিশ্বাসই করতে পারছিল না বাস্তবে রয়েছে। চিমটি কেটেও দেখেছে নিজের গায়ে ব্যথা পায় কিনা।
গাছপালার মতই এখানকার প্রাণীরাও বড়। হামিংবার্ড দেখেছে কবুতরের সমান। চিতাবাঘগুলো হয় বাঘের চেয়ে বড়। দেখতে দেখতে একসময় মুসা বলেছে, যা অবস্থা, কেঁচো দেখব সাপের সমান!
মাথা ঝাঁকিয়েছে কিশোর, তাই তো হয় এখানে। কেঁচো হয় তিন ফুট লম্বা। মাউন্টেইনস অভ দা মুনের ওপর একটা সাইন্টিফিক রিপোর্ট করেছিল ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ম্যাগাজিন, উনিশশো বাষট্টির মার্চে বেরিয়েছিল সংখ্যাটা। এখানকার দানবীয় প্রাণীদের উল্লেখ আছে তাতে। অভিযাত্রীরা দেখে গেছে তিন ফুট লম্বা কেঁচো।
তাহলে এই আজব জায়গা সম্পর্কে কিছু শোনা যায় না কেন?
যায় না কে বলল? ম্যাপ দেখলেই পেয়ে যাবে। ভিকটোরিয়া হ্রদের কাছে, অনেক টুরিস্ট যায়। ম্যাপে নাম রুয়েনজোরি। এর মানে রেইনমেকার, বা বৃষ্টি প্রস্তুতকারী। সারাক্ষণই বৃষ্টি হতে থাকে এখানে। আর এর জন্যেই কোন টুরিস্ট রিসোর্ট গড়ে ওঠেনি। মানুষের চোখে না পড়ার আরেকটা বড় কারণ হলো, বেশির ভাগ সময়ই মেঘে ঢাকা পড়ে থাকে এই অঞ্চল।
বাব্বাহ্! এই অবস্থা! নামটা রুয়েনজোরি, না? আমি তো জানতাম মাউন্টেইনস অভ দা মুন।
এটা রুয়েনজোরির আরেক নাম।
পুরানো, না নতুন?
পুরানো। প্রাচীন মিশরীয়রা রেখেছিল।
কেন?
আজব জায়গা বলে। পৃথিবীতে এমন অবস্থা আর কোথাও নেই। এ যেন অন্য এক পৃথিবী। তাই পুরানো ম্যাপে নাম ছিল লুনায়ে মনটিস, অর্থাৎ মাউন্টেইনস অভ দা মুন, অর্থাৎ চাঁদের পাহাড়। একহাজার বছরেরও বেশি কাল ধরে ম্যাপে ওই নাম থাকার পর হঠাৎ করেই মুছে ফেলা হলো। হয়তো লোকে তখন মনে করেছিল এ রকম জায়গা বলে কিছু নেই। কারণ পরের দিকে অভিযাত্রীরা আর এ জায়গাটা খুঁজে পায়নি। বিখ্যাত পর্যটক স্টেনলি-লিভিংস্টোনকে খুঁজে পেয়েছিলেন যিনি, তিনি একবার বলেছেন-ম্যাপে যে জায়গায় চাঁদের পাহাড় দেখানো রয়েছে, ওই জায়গাটাতে শুধু পানি, জাহাজে করে পার হয়েছি আমি; তার মানে ওখানে পাহাড় বলে কিছু নেই। সুতরাং ম্যাপ থেকে মুছে ফেলা হলো তখন। পরে আবার ফিরে এলেন তিনি। আফ্রিকার এই এলাকা ধরে যাওয়ার সময় কয়েক মুহূর্তের জন্যে মেঘ সরে গেলে বেরিয়ে পড়ল পর্বতের চূড়া-চিরতুষারের রাজত্ব, দেখে অবাক হয়ে গেলেন তিনি। ফিরে গিয়ে চাঁদের পাহাড়ের জায়গায় নতুন নাম বসালেন, রুয়েনজোরি।