আর বসে থাকা যায় না। মরিয়া হয়ে কিশোরই হাতির ডাক ডাকতে আরম্ভ করল। চিৎকারের পর চিৎকার।
সাড়া দিল ডাকাতেরা। হট্টগোল আর ছুটন্ত পায়ের শব্দ শোনা গেল। দৌড়ে এল একজন ডাকাত।
মুহূর্তে তাকে কজা করে ফেলল পুলিশ। পিস্তল ব্যবহারের সুযোগই পেল না লোকটা, কেড়ে নেয়া হলো। ধরেই হাত-পা বাঁধা শেষ।
কুয়াশা ফুঁড়ে বেরিয়ে এল আরেক ডাকাত। তাকেও আটকে ফেলা হলো।
তারপর বেরোল তিনজন একসঙ্গে। দু-জনকে কাবু করে ফেলা গেল কোন গোলমাল ছাড়া, কিন্তু তৃতীয়জন পিস্তল তুলে গুলি করে বসল।
পড়ে গেল একজন পুলিশ।
গুলির শব্দ শুনে দল বেঁধে ছুটে এল ডাকাতেরা। দশ-বারোজন একসঙ্গে বেরিয়ে এল কুয়াশার আড়াল থেকে। প্রচণ্ড হাতাহাতি লড়াই বেধে গেল পুলিশ আর কুলিদের সঙ্গে।
শেষ পর্যন্ত পারল না ডাকাতেরা। আটক হলো। হাতে গুলি খেল কিশোরের সবচেয়ে ভাল যোদ্ধাদের একজন, হামবি। কিন্তু তারপরেও লড়াই বন্ধ করল না।
ওষুধ লাগিয়ে তার জখম বেঁধে দিতে চাইল কিশোর।
ওসব পরে, বলে এড়িয়ে গেল হামবি।
রঙ করা হাতিটাকে নিয়ে কি ঘটছে দেখার জন্যে দৌড়ে গেল মুসা। একটা পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখল, ওটাকে ঘিরে ফেলেছে ডাকাতেরা। মোটা মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করছে। দুই দিকে হাতির ডাক শুনে হতবুদ্ধি হয়ে গেছে কয়েকজন ডাকাত। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কোনদিকে যাবে। যারা হাতির বেশি কাছে রয়েছে, তারা বুঝে ফেলেছে এটা রঙ করা হাতি, বিমূঢ় হয়ে গেছে এরা। ব্যাপারটা কি ঘটেছে মাথায়ই ঢুকছে না তাদের।
হঠাৎ আরেকটা হাতির চিৎকার কানে এল মুসার। এটা কিশোরের কণ্ঠ থেকে বেরোয়নি।
কি হয়েছে দেখার জন্যে দৌড়ে গেল সে। দেখল, সাদা হতিটা সরে গিয়েহল, ওটাকে ঘিরে ফেলেছে কয়েকজন ডাকাত। তলোয়ার দিয়ে খোঁচা। মেরে মেরে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে ওদের ক্যাম্পের দিকে। রাগে, যন্ত্রণায় চিৎকার করছে জানোয়ারটা।
ওদের নিষ্ঠুরতা দেখে মুসার মনে হলো এই লোকগুলোই হয়তো গায়ে গিয়ে সেদিন কিশোর হাতিটার শুড় কেটেছিল।
কিন্তু সাদা হাতি ভদ্র হলেও সহ্যের একটা সীমা আছে। কত আর কষ্ট সহ্য করবে? আচমকা ঘুরে গিয়ে রুখে দাঁড়াল সে। এ রকম কিছু ঘটতে পারে আশা করোন বোধহয় লোকগুলো। সরে যাওয়ারও সুযোগ পেল না। চোখের পলকে দু-জনকে দাঁত দিয়ে গেঁথে ফেলল হাতি। পা দিয়ে পিষে ভর্তা করে দিল আরেকজনকে। শুড় দিয়ে বাড়ি মেরে শুইয়ে দিতে লাগল নাগালে যাকে পেল।
সাদা হাতিটার চিৎকার শুনে সমস্ত বাধা পায়ে দলে পড়িমরি করে ছুটে এল কালো মন্দা হাতিটা। আক্রমণ করে বসল ডাকাতদের।
দুটো খেপা হাতির আক্রমণ ঠেকানোর সাধ্য হলো না ডাকাতদের। ঘাবড়ে গিয়ে এদিক ওদিক দৌড় মারল। গিয়ে পড়ল পুলিশ আর কুলিদের খপ্পরে।
ওরা জিতে গেছে, বুঝতে পারল কিশোর। কিন্তু বজ্রমানবের কথা ভুলে গিয়েছিল সে।
কুয়াশা সরে এসে ঢেকে ফেলল কিশোরকে। কয়েক সেকেন্ড পর সেটা সরতেই দেখল, ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে শেখ।
কুটিল হাসি হাসল ডাকাত সর্দার। বাহ্, তুমি এখানে! তোমাকেই খুঁজছিলাম!
খাপ থেকে পিস্তল খুলল সে।
দাঁড়ান, হাত তুলল কিশোর, আমার কাছে পিস্তল নেই। আমি শুনেছি, আরব যোদ্ধারা মুখোমুখি লড়াইয়ে নিরস্ত্র শত্রুকে হত্যা করে না। কাপুরুষতা মনে করে। আপনিও আরব। সাহস থাকলে পিস্তলটা ফেলে দিন। তারপর আসুন। দেখা যাক কে হারে, কে জেতে।
পিস্তল ফেলল না শেখ, তবে খাপে ঢুকিয়ে রাখল।
তুমি একজন আরব শেখকে কাপুরুষ বলো! এসো, দেখি, কতটা বাঘের বাচ্চা?
বিশাল বপু নিয়ে দু-হাত বাড়িয়ে রেলইঞ্জিনের গতিতে কিশোরকে আঘাত করতে ছুটে এল শেখ।
শেষ মহর্তে পথ থেকে সরে গেল কিশোর। জুডোর কায়দা প্রয়োগ করল শেখের ওপর। লোকটার নিজের ওজন আর শক্তিকে কাজে লাগিয়েই কাবু করার চেষ্টা করল তাকে।
বিফল হলো না। দড়াম করে মুখ নিচু করে পাথরের ওপর আছড়ে পড়ল যেন পাহাড়। মাথা ঠকে গেল ভীষণ ভাবে। অজ্ঞান হয়ে গেল।
যে কোন মুহূর্তে জ্ঞান ফিরে আসতে পারে লোটার। সঙ্গে দড়ি নেই। তাড়াতাড়ি শেখের লম্বা আলখেল্লা ছিঁড়ে ফালি করে দড়ি পাকিয়ে তার হাত-পা বেঁধে ফেলল কিশোর।
চোখ মেলল শেখ। হাত-পা নড়ানোর চেষ্টা করে পারল না। বুঝতে পারল, আর কিছু করার নেই তার। চুপ হয়ে গেল।
কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল পুলিশেরা, সঙ্গে মুংগা। অবাক হয়ে একবার তাকাতে লাগল পড়ে থাকা দানবটার দিকে, একবার কিশোরের দিকে।
ওরা বলছে, মুংগা বলল কিশোরকে, আপনি সাদা মানুষের জাদু ব্যবহার করেছেন। নইলে এই দৈত্যের সঙ্গে পারতেন না। আপনাকে পিষে ফেলত।
জাদুই, মুচকি হাসল কিশোর, তবে সাদা মানুষের নয়। এশিয়ানদের।
কুলিদের সহায়তায় বন্দিদের নিয়ে চলে গেল পুলিশ।
কিশোর-মুসা রয়ে গেল। তাদের অন্য কাজ আছে।
খুদে দানবকে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রেখে একজন লোককে তার পাহারায় রেখে দিয়েছিল মুসা। এখন দেখল, বড় হাতি দুটোর সঙ্গে গিয়ে বন্ধুত্ব করে ফেলেছে বাচ্চাটা। তার পরিকল্পনার এটাও একটা অংশ ছিল।
হাতির স্বভাব ভাল করে জানা আছে তার। মা-হারা বাচ্চা হাতিকৈ দেখাশোনার ভার পড়ে অন্য বয়স্ক মাদী হাতির ওপর। স্বেচ্ছায় এই দায়িত্ব নিয়ে নেয় হস্তিনী। খালা হয়ে যায় শিশুটার। প্রয়োজন পড়লে তাকে নিজের দুধ খাইয়েও বাঁচিয়ে রাখে।