প্রায় অন্ধকার গুহা। অল্প কয়েকটা মশাল জ্বলছে এখনও। এই সামান্য আলোয় এতবড় গুহার কিছুই আলোকিত করতে পারেনি।
প্রথমে কিছু চোখে পড়ল না তার। আরও ভাল করে তাকাতে দেখতে পেল কয়েকজন লোক ঘুমিয়ে আছে। চিতার মাথাকে বালিশ বানিয়েছে।
ফিসফিস করে বলল কিলোর, কঠিন ঠাই। কেউ জেগে উঠলেই এখন মরেছি।
অন্ধকার তো, মুসা বলল। দেখতে পাবে?
স্পষ্ট না দেখলেও আমাদের পোশাকই বুঝিয়ে দেবে ওদের দলের লোক নই। হলে আলখেল্লা থাকত।
ঘুমন্ত প্রহরীদের দিকে তাকাল মুসা। তাহলে আলখেল্লাই পরে নেব।
লোকগুলোর ভারি শরীর থেকে আলখেল্লা খোলাটা অত সহজ হলো না, তবে ভোলা গেল শেষ পর্যন্ত। দ্রুত সেগুলো পরে নিল ওরা। চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ফলে কেউ এখন বুঝতে পারবে না ওরা কারা।
নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে বড় গুহাটা ধরে এগোল তিনজনে। বুক কাঁপছে। দৌড় দিতে ইচ্ছে করছে। ধরা পড়ার ভয়ে দিল না।
প্রথম লোকটার পাশ কাটাল নিরাপদে।
মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে আরেক দিকে। তবে প্রয়োজন ছিল না-পরনে আলখে, মুখ তো দেখাই যায় না।
দ্বিতীয় লোকটার কাছে আসতেই মাথা তুলল সে। তিনটে সাদা আলখেল্লা পরা মূর্তি নজরে পড়ল। আবার মাথা নামিয়ে চোখ মৃদল সে।
ধীরেসুস্থে তৃতীয় এবং চতুর্থ লোকটার পাশ কাটাল ওরা।
গুহার বাইরে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। অলস ভঙ্গিতে তাকাতে লাগল এদিক ওদিক। যেন ভেতরে দম বন্ধ হয়ে আসছিল বলে বাইরের খোলা হাওয়ায় খাস নিতে এসেছে।
এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করল কেউ পাহারায় আছে কিনা।
কাউকে চোখে পড়ল না।
একদিকে হাঁটা দিল তখন। তারপরেও যখন কেউ ডাকল না, হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল শরীরে। আলখেল্লার ঝুল তুলে দিল দৌড়।
আগে আগে ছুটছে কিনোর। বাতাস গায়ে লাগতে মোড় ঘুরল। মনে আছে, বাতাসের বিপরীতে যেতে হবে। দিনের মত এত জোরাল না বাতাস, তবু বোঝ যায়।
দুর্গম পথ। চাঁদ আছে আকাশে। কিন্তু থাকলেই কি, কুয়াশার জন্যে ঠিকমত চোখে পড়ে না। এর ওপর নির্ভর করে চলা মুশকিল।
তবু থামল না ওরা। ছুটছে। কাঁটায় লেগে হাত-পায়ের চামড়া ছড়ে গেল, চোখা পাথরে পা কাটল, কিন্তু ছোটার বিরাম নেই।
চোখে পড়ল হোয়াইট লেক। সামনে, মৃদু চিকচিক করছে ঘোলাটে চাঁদের আলোয়।
ওই যে হাতিটা! বলে উঠল মুসা।
আশ্চর্য! দিনের বেলা যেখানে দেখেছিল, ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে ওটা।
কিন্তু আমি তো দেখছি দুটো, কিশোর বলল। যতটা সম্ভব তীক্ষ্ণ করে ফেলেছে দৃষ্টি। মনে হচ্ছে আরেকটা কালো হাতিও আছে। নাকি সাদাটারই ছায়া?
গুঁড়ি মেরে মেরে কাছে এগোতে লাগল ওরা।
মুহূর্তের জন্যে সরে গেল কুয়াশা। পরিষ্কার হলো ধোঁয়াটে চাঁদের আলো। না, আসলেই আছে আরেকটা হাতি। মদ্দা। স্পষ্ট দেখা গেল এখন। ওর কালো চামড়া এই আলোতেও বোঝা যাচ্ছে। নিচে নামবে কি করে ভাবল কিশোর। পথ একটাই, শ্যাওলার ভেতরের সুড়ঙ্গ। খুঁজে বের করা কঠিন হলো।
আবার ওটায় ঢুকব? ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না মুসার। এই মাঝরাতে!
ওটার মধ্যে দিনই কি আর রাতই কি? একই রকম অন্ধকার।
কিন্তু রাতের বেলা যদি চিতাবাঘ ঢুকে বসে থাকে?
থাকলে কিছু করার নেই। আর কোন উপায় নেই আমাদের। অসুবিধে একটাই হবে, হাতে-পায়ে পেঁচাবে এই আলখেল্লা।
খুলে ফেলব?
খুলে রেখে যেতে পারলেই ভাল হত। কিন্তু ভীষণ ঠাণ্ডা। শেষে নিচের ঝুল তুলে কোণগুলো শক্ত করে কোমরে পেঁচিয়ে বাঁধল ওরা। ঢুকে পড়ল সুড়ঙ্গে।
ভেতরে ছোট ছোট হাজারো শব্দের কোলাহল। অত সব শব্দ। কারা করছে, মোটামুটি জানা আছে ওদের। কিন্তু ছোট ছোট প্রাণীগুলোকে পরোয়া করল না। করার দরকারও নেই। কারণ ওগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আর হিংস্রতম যেটা, সেটা সিভেট ক্যাট। একধরনের বনবিড়াল। ওদের সাড়া পেয়ে ভয়ে ছুটে পালাল।
ঢোকার সময় যে অসুবিধে হয়েছিল মুসার, এখন পথ জানা থাকায় সেটা আর হলো না। বাইরে বেরিয়ে এল নিরাপদে।
নামতে নামতে ব্ল্যাক লেক আর গ্রীন লেকের পাশ কাটাল, তারপর বাশে ছাওয়া গরিলা-বনের ভেতর দিয়ে এসে পৌঁছল ক্যাম্পে।
এতটাই ক্লান্ত, কথা বলার শক্তিও আর নেই। সোজা বিছানায় পড়তে ইচ্ছে করছে, পড়েই ঘুম।
কিন্তু এখুনি একটা কাজ না সারলে হবে না, কিশোর বলল। ডাকাতদের আস্তানা কোথায় জেনে গেছি। পুলিশকে খবর দিতে হবে।
আউরোর বাবাকে জাগানো হলো।
রাতদুপুরে ছেলেকে দেখে প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাইল না। শেষে নেচে উঠল আনন্দে। তক্ষুণি একজন লোক পাঠাল পর্বতের পাদদেশে মটুয়াঙ্গা পুলিশ ফাঁড়িতে।
এত রাতে ঘুম থেকে ডেকে তোলায় মহা বিরক্ত হলো পুলিশেরা। সকালের আগে বেরোতে পারবে না, সাফ বলে দিল।
কি আর করা? অপেক্ষা করতেই হলো।
তবে কথামত সকালবেলা ওগাবোর গাঁয়ে এল ওরা। পথ দেখিয়ে ডাকাতদের গুহায় তাদের নিয়ে চলল কিশোর। সঙ্গে নিয়েছে তার দলবল।
গুহার কাছে পৌঁছল দুপুরের সামান্য আগে। কিন্তু গুহায় ঢুকে দেখা গেল খালি গুহা। কোন মানুষ নেই!
বন্দিরা পালিয়েছে জেনেই সাবধান হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয় ডাকাতেরা। পালিয়েছে। জিনিসপত্র সব নিয়ে গেছে। বাতাসে ভাসছে কেবল পুদিনার গন্ধ।
ভীষণ শয়তান ব্যাটারা! নাকমুখ কুঁচকে বলল কিশোর।
সাংঘাতিক দুর্গম পথ পার হয়ে আসতে পুলিশেরও কষ্ট হয়েছে। শীতে কাবু হয়ে গেছে ওরা। হাত-পায়ের নানা জায়গায় জখম। রাগটা পড়ল কিশোরদের ওপর। কিন্তু যেহেতু ডাকাতরা গুহায় থাকার প্রমাণ আছে, দোষ দিয়ে কিছু বলতে পারল না। কেবল কালো মুখগুলোকে আরও কালো করে রাখল।