কালো হয়ে গেল তার মুখ।.ঔনো রাগ ফুটল চোখের তারায়। দূর হয়ে গেল হাসি হাসি ভাবটা।
তবে সর্দারের ছেলেরা বেয়াদব হয়, ওকে আদব শিক্ষা দেব আমি! কিছু শিক্ষা ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে। এই ছেলে, মোয়রা, দেখাও তোমার বন্ধুদের।
নড়ল না আউরো।
আরবিতে তীক্ষ্ণ আদেশ দিল শেখ। দৌড়ে ঘরে ঢুকল একজন চাকর। আউরোকে চেপে ধরে জোর করে তার পিঠ ঘোরাল কিশোর-মুসার দিকে। চামড়ার চাবুক দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে দেয়া হয়েছে পিঠ।
মৃদু হাসল শেখ।
কড়া গলায় বলল মুসা, লাগতে হলে সমানে সমানে লাগা উচিত। একটা বাচ্চা ছেলেকে ধরে সবাই পেটাতে পারে, এতে বীরত্ব জাহির হয় না। কথা না শুনলে কি করবেন? পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলবেন?
না না, মারব কেন? টাকা আসে এমন কোন কিছুকেই মেরে ফেলি না আমি। ভাল গোলাম হবে ও। তবে তার আগে ওর তেজটা নষ্ট করতে হবে। ঘোড়াকে যেমন করে বশ মানানো হয়।
এই নিষ্ঠুরতার কি কোন প্রয়োজন আছে? কিশোরের প্রশ্ন।
নিষ্ঠুর? কি বলছ তুমি? আমরা অনেক ভদ্র। কি দিয়ে মেরেছি, দেখাচ্ছি, দাঁড়াও।
দেয়ালে ঝোলানো খুব সাধারণ দেখতে একফালি চামড়া নামাল শেখ।
দেখো হাত দিয়ে, বলল সে। একেবারে নরম। আমাদের ভাষায় একে যা বলে তার বাংলা করলে দাঁড়াবে কোমল শিক্ষা।
মনে করেছেন চিনি না, কিশোর বলল। অত্যাচার করার জন্যে যত খারাপ জিনিস বানিয়েছে মানুষ, তার মধে এটা একটা। দক্ষিণ আফ্রিকায় একে বলে স্যামবক। গণ্ডারের চামড়া কেটে বানিয়ে সিংহের চর্বি ডলে নরম করা হয়। নরম করাই হয় যাতে মারলে বেশি ব্যথা লাগে। চামড়ায়-ছুরির মত কেটে বসে যায়। আপনার মত নিষ্ঠুর মানুষেরা যারা একটা ছেলেকে পেটাতে দ্বিধা করে না, তারাই কেবল একে কোমল বলতে পারে। নিজের পিঠে পড়লে আর এই নাম রাখত না।
জ্বলে উঠল বজ্বমানবের চোখের তারা, তবে মুখে হাসি লেগে রইল।
মনে হচ্ছে তোমাদের এই বন্ধুটির মত একই শিক্ষা দরকার তোমাদেরও। তবে সেটা না করতে হলেই খুশি হব আমি। বেয়াদবি আমি সইতে পারি না। যারা করে, তাদেরকে আদব শিখিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। চাকরের দিকে চাবুকটা ছুঁড়ে দিল শেখ। সেটা লুফে নিয়ে আউয়োকে সহ পর্দার ওপাশে চলে গেল চাকর।
ছেলেদের দিকে তাকাল শেখ। আশা করি ওর পিঠে আরও বিশ ঘা চাবুক লাগবে। সেটা ওকে তো বটেই, তোমাদেরও ভদ্র হতে শেখাবে। পর্দার ঠিক ওপাশেই কাজটা করা হবে, যাতে চিৎকারটা তোমরাওঁ শুনতে পাও।
চাবুকের প্রথম বাড়িটা পড়তেই বাঘের মত লাফিয়ে উঠল মুসা।
টেনে তাকে বসিয়ে দিল কিশোর।
কিছু করলে আউরোর ক্ষতিই করবে শুধু। বসে থাকো। আমাদের সুযোগ আসবে।
বিশটা বাড়ি শেষ হলো। টু শব্দ শোনা গেল না আউরোর। নিরাশ হলো শেখ, তার চেহারাই সেটা বলে দিচ্ছে। প্রতিটি বাড়ি পড়েছে আর দাঁতে দাঁত, চেপেছে কিশোর-মুসা, যেন তাদের নিজের পিঠে পড়েছে।
শেষ হয়ে গেলে শেখ বলল, ওরটা আপাতত শেষ। এবার তোমাদের ব্যবস্থা। হয়তো ভাবছ ধরে নিয়ে আসা হলো কেন?
আমাদেরও গোলাম বানানোর ইচ্ছে নাকি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না। তোমাদের কিনতে রাজি হবে না কেউ। তোমাদের দিয়ে কাজ তো হবেই না, অকারণে ঝামেলা বাড়াবে। শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে থেকে থেকে ওদেরই মত হয়ে গেছ তোমরাও। বশ মানানো কঠিন। সব সময় খালি পালানোর চিন্তায় থাকবে। যেহেতু তোমরা আমেরিকার নাগরিক, তোমাদের সরকারও গোলমাল করতে পারে। না, কোটিপতির প্রাসাদের আরামের জীবন তোমাদের জন্যে নয়। ভাগ্য এত ভাল নয় তোমাদের।
তাহলে আটকে রেখেছেন কেন?
কারণ আছে। জানোয়ার ধরার ওস্তাদ তোমরা। আজ একটা সাদা হাতির কাছে তোমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে আমার লোকেরা। এত দামী জানোয়ার সারা দুনিয়ায় আর নেই। তোমরা ওটাকে ধরার চেষ্টা করবেই। তাই তোমাদের ঠেকিয়েছি।
কেন?
কেন, সেটা না বোঝার মত বোকা নও তোমরা। তোমাদের মত আমিও জানি ওটাকে কোথায় বিক্রি করলে বেশি দাম পাওয়া যাবে। একটা হাতির দামে দশটা ক্যাডিলাক গাড়ি কিনতে পারব। হাতিটা ধরে বিক্রি না করা পর্যন্ত তোমাদের আটকে রাখতেই হচ্ছে।
ততক্ষণ কি আমার লোকেরা বসে বসে আঙুল চুষবে মনে করেছেন? ওরা আমাদের খুঁজবে। খুঁজে বের করবে এই গুহা। দলে ওরা অনেক, সেই তুলনায় আপনারা অনেক কম। শুধু শুধু প্রাণ খোয়াবেন। প্রাণের চেয়ে কি বড় হয়ে গেল একটা হাতি?
কুটিল হাসি হাসল বজ্রমানব।
সাধারণ হাতি হলে অন্য কথা ভাবতাম। কিন্তু শ্বেতহস্তী সাধারণ নয়। জানো, অনেক দেশে দেবতা মানা হয় একে? পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরেছি আমি, বাঘায় গেছি, সিয়ামে গেছি-থাইল্যান্ডকে অনেকে বলে সিয়াম, আমারও এই নামটাই ভাল লাগে। শ্বেতহস্তীকে নিয়ে যে কি করে ওরা, না দেখলে বুঝবে না।
পাগল-ছাগল সব দেশেই আছে, মুখ গোমড়া করে বলল মুসা।
তা বলতে পারো। মস্ত এক ধনীর বাড়িতে একবার একটা সাদা হাতি দেখেছিলাম। মার্বেল পাথরে বাঁধানো শানদার বিশাল এক চতুরে ওটাকে রাখা হত। সোনা-রূপার কারুকাজ করা অনেক দামী সিল্কের কাপড়ে সারাক্ষণ ঢেকে রাখা হত ওটার পিঠ। কাপড়ের স্কুলগুলোর কি বাহার, একেবারে গোড়ালির ওপর নামানো। সোনার মালা বানিয়ে পরিয়ে রাখা হত দাতে। মাথার ওপর ধরে রাখা হত রাজকীয় ছাতা, যাতে রোদে কষ্ট না পায় হাতি।