কিন্তু যদি মুক্তি পায় ডাকাতদের কবল থেকে, তবে তো; মস্ত একটা যদি রয়ে যাচ্ছে।
প্রায় ঘন্টা দুই একটানা চলার পর সামনে কথার শব্দ শোনা গেল।
হঠাৎ করে পিঠ থেকে বাতাস এবং তলোয়ার দুটোই সরে গেল। বেশ উষ্ণ এখানে আবহাওয়া। রান্নার সুগন্ধ ভুরভুর করছে।
বন্দিদের চোখ থেকে কাপড় খুলে নেয়া হলো।
বিরাট এক গুহায় এসে ঢুকেছে ওরা। সেজন্যেই আর বাতাস লাগছে না। পিঠে। মশালের আলোয় আলোকিত। আগুনের বড় কুণ্ড গরম করে রেখেছে গুহাটা। হাত থেকে ফটিকের ঝাড়বাতির মত ঝুলে আছে স্ট্যালাকটাইট। ঝালর লাগানো দামী কাপড়ে ঢাকা দেয়াল। মেঝেতে চিতাবাঘের চামড়ার কার্পেট। সাদা আলখেল্লা পরা মানুষেরা বসে আছে তাতে। বাঘের মাথাকে তাকিয়া বানিয়ে ঠেস দিয়েছে। হাতে পুদিনার গন্ধ মেশানো চায়ের পেয়ালা।
এ কোথায় ঢুকলামরে বাবা! কিশোর বলল। মনে হচ্ছে হাজার বছর পেরিয়ে এসে ঢুকেছি আরব্য রজনীর জগতে।
কিংবা কাউন্ট মস্টিক্রিস্টোর প্রাসাদে! বিড়বিড় করল মুসা।
.
১২.
তোমাদের পছন্দ হয়েছে জেনে খুশি হলাম! ইংরেজিতে কথা বলল কেউ।
সাংঘাতিক ভারি কণ্ঠস্বরটা এল যেন গুহার দেয়াল ভেদ করে। জবাব যখন দিয়েছে, নিশ্চয় তাদের বাংলা বুঝতে পেরেছে। এই বিদেশ-বিভুইতে বাংলা বোঝে কেউ, এটা জেনে হাঁ হয়ে গেল দুই গোয়েন্দা।
বিশালদেহী একজন মানুষ। সাত ফুটের কাছাকাছি লম্বা, সেই পরিমাণ চওড়া। অন্যদের মত সাদা পোশাক পরেনি। বরং তার আলখেল্লাতে রামধনুর সাতটা রঙই বিদ্যমান, খুব দামী, চমৎকার সিল্কের কাপড়ে তৈরি, মশালের আলোয় চকচক করছে। সোনা-রূপায় তৈরি, মূল্যবান পাথর বসানো একটা ব্রেস্ট প্লেট পরেছে বুকে। মাথায় পাগড়ির বদলে রয়েছে সিংহের কেশরে বানানো মুকুটের মত একটা জিনিস। কোমরের বেল্টের জন্যে জীবন দিতে হয়েছে একটা তুষার-চিতাকে। একপাশে খাপে ঝোলানো অলঙ্করণ করা একটা বড় পিস্তল, আরেক পাশে তলোয়ার। সূক্ষ্ম এমব্রয়ডারি করা স্লিপার পায়ে, কিশোরের পায়ের প্রায় দ্বিগুণ হবে একেকটা পা। বিশাল পায়ের ছাপের কথা মনে পড়ল তার।
দাস ব্যবসায়ীদের সর্দার লোকটা, বুঝতে অসুবিধে হলো না ছেলেদের। একেই উয়াটুসিরা বঙ্গমানব বলে জানে।
কিন্তু এক্ষণে বজ্রমানবের মুখে মেঘ বা বজের কোন চিহ্ন নেই, তার জায়গায় রয়েছে উজ্জ্বল রোদ। তামাটে রঙের মুখে ঝকঝক করে উঠল সাদা দাঁত।
মাথা নুইয়ে সালাম জানাল লোকটা। ইংরেজিতে বলল, বাংলা বুঝতে পারি, বলতে পারি না। আমার তেলের কোম্পানিতে অনেক বাংলাদেশী আর ভারতীয় আছে, তারা বাংলায় কথা বলে। নোয়াখালীর একজন ফোরম্যানের কাছে অল্প-স্বল্প বাংলা শিখেছি। যাই হোক, আমার বাড়িতে স্বাগত জানাচ্ছি তোমাদের। নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। বিশ্রাম দরকার। এসো আমার সঙ্গে।
লোকটার মোলায়েম ব্যবহারে. পিত্তি জ্বলে গেল কিশোরের। অনেকগুলো বাজে কথা মুখে এসে গিয়েছিল, কিন্তু চেপে গেল। এ সব বলার সময় নয় এখন।
পর্দা সরিয়ে আরেকটা ছোট গুহায় ঢুকল বস্ত্রমানব। এটা আরও জমকালো করে সাজানো। চিতার চামড়ার ওপর রাখা পুরু গদি। নরম বালিশে হেলান দিয়ে তাতে আধশোয়া হলো লোকটা। কিশোর-মুসাকেও গদি দেখিয়ে আরাম করতে বলা হলো।
কঠোর পরিশ্রমের পর গা এলিয়ে দিতে পেরে খুশিই হলো ওরা।
ট্রে হাতে ঢুকল একজন চাকর। ট্রেতে পুদিনার সুগন্ধ দেয়া তিন কাপ গরম চা আর কিছু কেক।
দেখো আমাদের চা খেতে পারো কিনা, বস্ত্রমানব বলল। সরি, কফি দিতে পারলাম না, নেই। ইউরোপ-আমেরিকায় ঘোরার সময় কফিই খাই, তবে বাড়ি ফিরলে চা।
এটা আপনার বাড়ি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না না, হেসে উঠল বমানব। এটা সাধারণ শিবির। পারস্য উপসাগরের তীরের একটা দেশে পঞ্চাশ হাজার মানুষের আমি শেখ। টাকার অভাব নেই আমার। কিন্তু শুধু টাকায় মন ভরে না, অ্যাডভেঞ্চারের প্রবল নেশা, তাই বেরিয়ে পড়ি মাঝে মাঝে। প্রাসাদ ছেড়ে চলে আসি গুহায়। লোক রেখে আসি আমার প্রজাদের প্রতি যাতে কোন অবিচার না হয় সেটা দেখার জন্যে, আর আমি এসে এখানে আইন ভাঙি।
বেআইনী কাজ যে করেন স্বীকার করছেন?
করব না কেন? যেটা তোমরা জেনেই গেছ, সেটা লুকিয়ে লাভ কি? কয়েকবার গেছি তোমাদের ক্যাম্পে। তোমাদের বন্ধু উয়াটুসিদের গ্রাম থেকে বেশ কয়েকজনকে ধরে এনেছি, খুব ভাল চাকরের কাজ করতে পারে ওরা। ওদেরকে এমন লোকের কাছে পাঠাই, যারা ভাল টাকা দেয়।
সর্দারের ছেলেকে ধরে এনেছেন। তাকেও পাঠিয়ে দিয়েছেন?
না, এখনও এখানেই আছে। দেখতে চাও?
জবাবের অপেক্ষায় না থেকে হাততালি দিল শেখ।
একজন চাকর ঢুকল।
আরবিতে তাকে হুকুম দিল শেখ।
খানিক পর পর্দা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকল আউরো। বন্ধুদের দেখে আনন্দে চিৎকার করে ছুটে এসে তাদের হাত চেপে ধরল।
তোমরা এসেছ! জানতাম আমাকে নিতে আসবে!
তোমাকে নিতে আসিনি, শুকনো স্বরে বলল কিশোর। আমরাও তোমার মতই বন্দি। তোমাকে কোন সাহায্য করতে পারব না।
দপ করে আলো নিভে গেল ওগাবোর মুখ থেকে।
অ। হাসিমুখে মিঠে মিঠে কথা বলছে আর খাবার দিচ্ছে বলেই এই শেখকে বিশ্বাস কোরো না। ও খুনী।
হা হা করে হেসে উঠল শেখ।
ছেলেটাকে আমার ভীষণ পছন্দ। ওর তেজ আছে। এ ভাবে আমার সামনে কথা বলতে সাহস করে না কেউ। সর্দারের ছেলে তো, সর্দারের মতই কথা।