একেবারে কাছাকাছি যেতে পারলে বুঝতে পারত, এই হাতিটার ফ্যাকাসে ভাবটা কতখানি বেশি। যত বেশি হবে, তত দাম বাড়বে।
মুসাও কিশোরের মতই সাবধানে এগোচ্ছে। শ্বেতহস্তীর দাম তারও জানা।
ওদের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না হাতিটা।
দশ ফুটের মধ্যে চলে এল দুজনে। তারপর থামল।
এই মুহূর্তটা জীবনে ভুলবে না ওরা। দম বন্ধ হয়ে আসছে উত্তেজনায়।
এটার চামড়ায় ফ্যাকাসে ভাবটা অনেক বেশি, সেজন্যেই দূর থেকে কুয়াশার মধ্যে সাদা লাগছিল। মাঝে মাঝে লালচে ছোপ। পিঠটা সাদা, ময়লা তুষারের মত, যেন তুষার জমা পর্বতের চূড়া। নখ সাদা, চোখের রঙ লালচে-সাদা। কান আর মাথায় সাদার মধ্যে লাল লাল ছোট-বড় ফুটকি।
আর কোন সন্দেহ নেই, শ্বেতহস্তীই এটা! মাদী হাতি।
সাদা হাতি যে, তার আরও একটা বড় প্রমাণ, কালো হাতির মত বদমেজাজী নয়। মারচিসন ন্যাশনাল পার্কে একটা সাদা গণ্ডার ছিল। অনেকেই লিখেছে ওটার। কথা। খুব নাকি দ্র ছিল ওটা, সাধারণ গণ্ডারের মত বদমেজাজী নয়। সাদা খরগোশ, সাদা ইঁদুর, কালো কিংবা ধূসর জাতের পাখি যেগুলো সাদা হয়ে যায়, সবই নাকি শান্ত স্বভাবের হয়। সাদা রঙের তুষার-চিতাকে ভয় পায় না মানুষ। অথচ কালো চিতা আর কালো জাগুয়ার ভয়ানক হিংস্র হয়।
যে চিড়িয়াখানা এই হাতিটাকে পাবে, তারা অতি ভাগ্যবান। দর্শকদের জন্যে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হবে এটা। অনেক চিড়িয়াখানার এই হাতি কেনার সামর্থ্যই নেই। জাপানীদের আছে, দুর্লভ জানোয়ারের জন্যে তারা খরচও করে। ওরা ঘোষণা করেছে দুই লাখ ডলার দেবে, চাপাচাপি করলে আরও অনেক বেশিও। দিতে পারে, বিশেষ করে এই হাতিটার জন্যে।
মাত্র দশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে এতগুলো টাকা, অথচ ধরে নিয়ে যাওয়ার কোন উপায় দেখছে না ওরা। এতবড় একটা হাতির বিরুদ্ধে দুটো ছেলে কিছুই করতে পারবে না। ধরতে হলে অনেক লোকবল দরকার। এই সাফারির জন্যে যত লোক ভাড়া করেছে ওরা, সবাইকে নিয়ে এলেও হয়তো কাজ হবে না। একটাই কাজ করার আছে আপাতত, জানোয়ারটাকে বিরক্ত না করে, চমকে না দিয়ে চুপচাপ পিছিয়ে যাওয়া। তারপর লোকজন নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসা।
হাতিটার ওপর চোখ রেখে আস্তে আস্তে পিছাতে শুরু করল দু-জনে। যে ভাবে এগিয়েছিল, তার চেয়ে সাবধানে।
হঠাৎ কানের কাছে কথা বলে উঠল একটা ভারি কণ্ঠ।
চমকে ফিরে তাকাল ওরা।
ছয়জন লোক দাঁড়িয়ে আছে। পরনে আরবদের সাদা পোশাক। হাতে পিস্তল আর তলোয়ার।
দৌড় দেব নাকি? মুসা বলল।
লাভ নেই। গুলি করে মেরে ফেলবে। বরং কথা বলে দেখি। বাংলা বোঝা প্রশ্নই ওঠে না, ইংরেজিও যে বোঝে না সেটা বোঝা গেল জিজ্ঞেস করতেই, নেতার কাছে জানতে চাইল কিশোর, ইংরেজি জানেন?
জবাবে রাগী ভঙ্গিতে মাথা নাড়ানো আর কিছু আরবী শব্দের তুবড়ি। আকামি যা বলেছে, ঠিক সে-রকম ওদের গায়ের রঙ-সাদাও না, কালোও না। মরুভূমিতে জন্ম, সেখানকার রোদ গাঢ় বাদামী করে দিয়েছে ওদের চামড়া। মাথায় পাগড়ি জড়ানো। পা খালি, জুতো-স্যান্ডেল কিছু নেই। তুষার মাড়াচ্ছে, অথচ ভঙ্গি দেখে মনে হয় না কোন অসুবিধে হচ্ছে। কঠিন লোক ওরা।
কথা বলতে বলতে একবার হাতিটার দিকে, একবার ছেলেদের দিকে তাকাঁচ্ছে নেতা।
ওদের উদ্দেশ্য আন্দাজ করতে পারছে কিশোর।
তাবুতে হামলা মনে হয় এরাই চালিয়েছে, বাংলায় বলল সে। কোনভাবে জেনেছে, হাতি ধরতে এসেছি আমরা। ওরাও এসেছে একই উদ্দেশে। আমাদের হাতিগুলো ওরা চুরি করেছে। এটাকে ধরতেও বাধা দেবে।
এমন ভঙ্গি করো, যেন কোনই আগ্রহ নেই আমাদের।
তাই করতে হবে। চুপচাপ সরে পড়ি চলো। অবশ্য যদি যেতে দেয়।
যেতে দিল না ওরা। যেই পা বাড়াল ছেলেরা, পিস্তলের নল ঠেসে ধরা হলো পিঠে। কাপড় ছিঁড়ে চোখ বেঁধে ফেলল। কেড়ে নেয়া হলো ছুরি দুটো। তারপর এগোনোর জন্যে বেশ জোরে, ব্যথা দিয়ে খোঁচা মারল পিঠে।
চলতে চলতে পাথরে পিছলে, হোঁচট খেয়ে, কিংবা উঁচু-নিচুতে তাল, সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে এগোল দুজনে। সেসব ক্ষেত্রেও খোঁচার বিরাম নেই। অকারণেই মারছে। কখনও গালাগাল, কখনও তলোয়ারের খোঁচাও সহ্য করতে হচ্ছে।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? মুসার প্রশ্ন।
বোধহয় ওদের ক্যাম্পে। জায়গাটা কোথায় গোপন রাখতে চায়, সেজন্যেই চোখ বেঁধেছে।
নিয়ে গেলে ভালই হয়। আউরোকে দেখতে পাব। মুক্ত করতে পারব।
জবাব দিল না কিশোর। মুসার দুঃসাহস যে কতখানি, ভাল করেই জানে সে। যত সহজে মুক্ত করার কথা বলছে, একদল গলাকাটা ডাকাতের হাত থেকে সেটা যে তত সহজ হবে না, মুসা নিজেও বুঝতে পারছে। তবু আশা ছাড়ছে না।
খুব কষ্ট হচ্ছে এগোতে। শ্যাওলার সুড়ঙ্গে হামাগুড়ি দিয়েই কাহিল হয়ে গেছে। এখন এই দুর্গম পথ। তার ওপর খিদে। পা চলতে চায় না। তবে একটাই স্বস্তি, এই হাঁটাহাঁটির ফলে শরীরটা গরম রয়েছে, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায়ও জমে যায়নি এখনও। অবশ্য পিঠে ধারাল তরবারির ফলা ঠেকে থাকলে, আর কখন খচ করে ঢুকে যায় ভাবলে এমনিতেই গরম হয়ে থাকে শরীর।
সোজাসুজি না গিয়ে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ঘুরপথে নেয়া হলো ওদের, কোন দিকে যাচ্ছে দ্বিধায় ফেলে দেয়ার জন্যে, যাতে পথ চিনতে না পারে।
তবে একটা ব্যাপারে অসাবধান হলো ডাকাতেরা, বাতাস। এ অঞ্চলে আসার পর থেকে লক্ষ করেছে কিশোর, বাতাস বয় পশ্চিম থেকে পুবে। অনেক ঘোরাঘুরির পর অবশেষে যখন সোজা এগোল ওরা, খেয়াল করল বাতাস লাগছে তার পিঠে। তথ্যটা মনে গেঁথে নিল সে। ডাকাতের আস্তানা থেকে বেরোতে পারলে বাতাসের বিপরীতে এগোতে হবে। তাহলে পৌঁছে যাবে হোয়াইট লেকে, সেখান থেকে ব্ল্যাক লেক আর গ্রীন লেক পেরিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যেতে পারবে।