কিন্তু এখানে ঘুমানো অসম্ভব মনে হলো তার। শ্যাওল-বনে বুকে হেঁটে চলা কৎসিত প্রাণীর অভাব নেই, ওগুলো জাগিয়ে রাখল তাকে। চুপ করে থাকলেই শরীরের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
কাঁপুনি উঠে গেল এক সময়।
জমে যাচ্ছি ঠাণ্ডায়, বলল সে। চলো, এগোই। না হলে শরীর গরম থাকবে না।
বাপরে বাপ, এমন ঠাণ্ডার ঠাণ্ডা। মনে হচ্ছে মেরু অঞ্চলে আছি! আবার এগোতে শুরু করল কিশোর।
খানিক দূর এগিয়ে থেমে গেল। এই মুসা, দেখো, মনে হয় এসে গেছি। আলো দেখতে পাচ্ছ?
নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলল ওরা।
আলোটা বাড়ছে ক্রমে।
অবশেষে বাইরে বেরিয়ে এল ওরা। আলো এত উজ্জ্বল লাগল, চোখই মেলতে পারল না ঠিকমত, মিটমিট করতে থাকল। অথচ আলো যে খুব বেশি, তা নয়। রোদের চিহ্নও নেই, মেঘে ঢাকা সূর্য; এমন লাগছে বেশিক্ষণ একটানা অন্ধকারে থেকে দিবালোকে বেরিয়ে আসার কারণে।
আমি মনে করেছিলাম বিষুবরেখার কাছাকাছি আছি, মুসা বলল। কিন্তু এ তো মেরু অঞ্চল।
বিষুবরেখাতেই আছি। তবে সাগরসমতল থেকে অনেক ওপরে তো, তাই এত ঠাণ্ডা। আল্পস পর্বতের চুড়ার চেয়েও ওপরে রয়েছি আমরা।
চোখে অবিশ্বাস নিয়ে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। যাহ্, বেশি বলে ফেলছ! তা কি করে হয়? মন্ট ব্ল্যাঙ্কের উচ্চতা পনেরো হাজার ফুট।
জানি। কিন্তু এটার চূড়া সতেরো হাজারের কাছাকাছি। আমরা আছি প্রায় ষোলো হাজার ফুট উঁচুতে।
মস্ত বড় পর্বতারোহী হয়ে গেলাম তো তাহলে। তাই তো বলি, এত শীত, লাগে কেন! কিন্তু এত ওপরে, এই ঠাণ্ডাতেও যে দাবানল লাগতে পারে, জানতাম না। দেখো, কত ছাই।
ছাই? কুয়াশার জন্যে ঠিকমত দেখতে পাচ্ছি না আসলে। ছাই কোথায়?
এই তো।
হাত রেখে দেখো।
হাত রাখল মুসা। হাতে লেগে গেল ভেজা ভেজা সাদা জিনিস।
আরি, তুষার! বিষুব অঞ্চলে তুষার! স্বপ্ন দেখছি নাকি!
আরও দেখো। ওই যে, হ্রদটা, হোয়াইট লেক।
কুয়াশা বড় বেশি সচল এখানে। এই সরছে, এই জমছে। সরে যেতে বেরিয়ে পড়েছে হ্রদটা। আক্ষরিক অর্থেই সাদা। পানির ওপরে পুরোটা বরফ হয়ে আছে। তার ওপর হালকা তুষারের আস্তরণ।
কেমন পাথুরে, মরু প্রকৃতি এখানকার। দানবীয় ফুল আর গাছপালা অনেক পেছনে পড়ে আছে। কুয়াশার চাদরের ওপাশে কোথাও রয়েছে পর্বতের আকাশ কুঁড়ে ওঠা চূড়া। আছে বরফের নদী। যেখান থেকে যখন তখন হিমবাহ নেমে যায় নিচের খাড়ির দিকে।
কুয়াশা কুণ্ডলীর ফাঁকে ফাঁকে নিচের আজব দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, যেন এলিসের মত এক আজব দেশে এসে পড়েছে ওরা। যেখানকার সবই অদ্ভুত। পর্বতের কোলে বিশাল ছড়ানো আঙিনায় যেন বিষণ্ণ হয়ে ঘুমিয়ে আছে কালো ব্ল্যাক লেক। তার নিচে ব্যালকনিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে যেন গ্রীন লেক, চারপাশের জঙ্গলের পটভূমিতে একটা রত্নের মত জ্বলছে।
নিচে, অনেক নিচে, পর্বতের পাদদেশে চোখে পড়ছে ছোট হোটেলটার চালাগুলো, যেখানে গেস্ট বুকে দেখেছে সেই সব বিখ্যাত মানুষদের নাম, যারা এই পর্বতের চূড়ায় চড়ার বহু চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অনেক রাজকুমার, কাউন্ট, ডিউক, এবং রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির লোয়েল টমাস জুনিয়র আর অ্যাডলাই স্টিভেনসনের মত অভিযাত্রীরা।
তবে গেস্ট বুকে খুব কম নামই লেখা আছে। আরও হাজার হাজার মানুষ সেই অনাদিকাল থেকে ঘুরে গেছে এই রহস্যময় পর্বতের পাদদেশ থেকে, চেষ্টা চালিয়েছে এর চূড়ায় ওঠার।
আবার এগিয়ে এল কুয়াশার ধূসর চাদর, চোখের সামনে বাধা হয়ে ঢেকে দিল নিচের অপরূপ দৃশ্য-হৃদ, জঙ্গল, বাড়িঘর।
চন্দ্রপৃষ্ঠের চেয়েও বিস্ময়কর এই পর্বতের জন্যে চাঁদের পাহাড় নামটা মোটেও অসঙ্গত নয়!
১১.
বাতাসে ক্রমাগত রূপ বদল করছে কুয়াশা। অদ্ভুত সব আকৃতি তৈরি হচ্ছে-কোনটা স্তম্ভ, কোনটা গাছ, কোনটা বা আবার একশো ফুট লম্বা মানুষ।
কিশোর, আমার গা ছমছম করছে, মুসা বলল। ওই যে ওই কুয়াশার স্তরটাকে দেখো, মনে হয় যেন একটা হাতি। সাদা হাতি।
আজব জিনিসটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। কুয়াশার মত আচরণ করছে না। কুয়াশা হলে এক আকৃতিও বেশিক্ষণ থাকত না, বাতাসেও সরে যেত। এই জিনিসটা সরছে না। একই জায়গায় একভাবে দাঁড়িয়ে আছে। যেন একটা সাদা হাতি, কিংবা সঠিক ভাবে বললে ছাই-সাদা হাতি।
চোখ ডলল কিশোর।
এখনও আছে ওটা।
উত্তেজনায় টগবগিয়ে উঠল, রক্ত।
এ সত্যি হতে পারে না। শ্বেতহস্তী খুব দুর্লভ। একটা সাদা হাতির জন্যে ওদেরকে দুই লক্ষ ডলার দেবে বলেছে টোকিও চিড়িয়াখানা।
কিশোরের মনে হলো স্বপ্ন দেখছে। তবে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন যে ভাবে দ্রুত বদলাতে থাকে, এটা তেমন করে বদলাচ্ছে না। এক রকম রয়ে গেছে।
কাছে এগোনোর চেষ্টা করলে হয়তো কুয়াশা হয়ে মিলিয়ে যেতে পারে হাতিটা। তখন নিশ্চিত হতে পারবে, স্বপ্ন, নাকি চোখের ভুল?
দেখা যাক এটা সত্যি কিনা, বলল সে। এসো। খুব আস্তে, এক পা এক পা করে।
এগোতে লাগল ওরা।
নড়ল না দানবটা। মিলিয়ে গেল না। ভয় পেয়ে পালাল না। রেগেও গেল না। যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। হয়তো আর কখনও মানুষ দেখেনি। সুতরাং জীবগুলোকে ভয় পাবে, না ঘৃণা করবে, বুঝতে পারছে না।
আরও কাছে এসে কিশোর দেখল, সাদাটা আসলে কুয়াশার জন্যে মনে হয়েছে। কিন্তু কুয়াশার মধ্যে আরও হাতি তো দেখেছে আগে, ওগুলোকে তো এ রকম মনে হয়নি? এটাকে এখন হালকা ধূসর লাগছে। তাতে নিরাশ হলো না সে। জানা আছে, শ্বেতহস্তী বলতে ধবধবে সাদা হাতি নয়। তুষার শুভ্র হাতির কথা কেবল গল্প-কাহিনীতেই লেখা থাকে। বাস্তবে যেগুলোকে সাদা হাতি বলা হয়, সেগুলোর চামড়া পুরোপুরি কালো নয়, ফ্যাকাসে ধূসর।