কিন্তু মন কি আর ফাঁকিতে পড়ে? ঠিকই বুঝতে পারছে, পরিশ্রমে নয়, বুক কাঁপছে প্রচণ্ড ভয়ে। ফাঁদে পড়া ইঁদুরের চেয়েও খারাপ অবস্থা হয়েছে তার।
অন্ধকার এই গর্তের মধ্যে বোঝারও উপায় নেই কোথায় ঘাপটি মেরে আছে হিংস্র জানোয়ার, কিংবা মারাত্মক বিষাক্ত সাপ। কোনদিকে যাচ্ছে তা-ও বোঝা যায় না। যদি দেখতে পেত, এতটা অনিশ্চয়তায় ভুগত না।
ছুরি দিয়ে ছাতে খোঁচা মেরে দেখল। গায়ে গায়ে জড়িয়ে গিয়ে শক্ত রবারের। মত হয়ে আছে শ্যাওলা। কাটার জন্যে খুঁচিয়েই চলল। হাত ব্যথা হয়ে গেল। কিন্তু থামল না সে। অনেক চেষ্টার পর অবশেষে ছাত দিয়ে দেখা গেল এক চিলতে আলো।
দ্বিগুণ উদ্যমে খোঁচাতে থাকল সে।
মাথা গলানোর মত একটা ফোকর করে ফেলল।
আলোয় মাথা বের করতে পারাটা একটা বিরাট স্বস্তি। কিন্তু লাভটা কি? চারদিকে যেদিকেই তাকায় কেবল শ্যাওলা, শ্যাওলা আর শ্যাওলা। তা-ও বেশিদূর দৃষ্টি চলে না। কুয়াশায় গিলে নিয়েছে যেন শ্যাওলার বনকেও।
কোনটা যে কোন দিক, বাইরেটা দেখে আরও অনিশ্চিত হয়ে গেল। কিছু বোঝার উপায় নেই। ভেতরে তো অন্তত দুটো সুড়ঙ্গ আছে, যে কোন একটা বেছে নিতে পারে। এখানে কি আছে? কিছু না।
আবার মাথা নিচু করে ফেলল। হাত-পায়ে ভর দিয়ে এগোল ডানের সুড়ঙ্গ ধরে।
কিশোরের নাম ধরে ডাকল আবার।
সাড়া নেই।
বুঝল, এভাবে ডেকে ডেকে অহেতুক দমই শেষ করবে, লাভ হবে না।
ছড়ে যাওয়া তালু আর হাটুতে ভর দিয়ে দ্রুত এগিয়ে চলল। প্রতিবার হাত বাড়াতে গিয়েই মনে হচ্ছে এই বুঝি হাতটা পড়ল মসৃণ, পিচ্ছিল কোন ঠাণ্ডা কিলবিলে শরীরে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠবে সরীসৃপটা, ছোবল মারবে।
কিন্তু তেমন অঘটন ঘটল না।
আরেকটা দুই-সুড়ঙ্গের কাছে পৌঁছাল সে।
ডানে যাবে না, বায়ে?
দুটো একই রকম মনে হলো তার, বায়েরটাই ধরল।
একটু পরেই থেমে গেল। কান পেতে আছে। সামনে মৃদু একটা খসখস শব্দ। এগিয়ে আসছে।
কিছু একটা আসছে!
আশা করল, ছোট কিছু হবে, নির্বিষ, ক্ষতি করতে পারবে না, এমন কিছু, শজারু কিংবা খরগোশ। কিন্তু অত ছোট জানোয়ার এমন শব্দ করতে পারবে না। শব্দটা হচ্ছে সুড়ঙ্গের ছাত আর দেয়ালে ঘষা খাওয়ার ফলে।
দ্রুত মনের পর্দায় খেলে গেল ভয়াবহ কতগুলো জর মুখ। প্রাণীটা গরিলা, দানবীয় পিঁপড়ে ভালুক কিংবা জঘন্য হায়েনা হতে পারে। তিনটেই সাংঘাতিক জীব। শুয়োরও কম বিপজ্জনক নয়। ক্ষুরের মত ধারাল দাঁত ওগুলোর। চোখের পলকে চিরে ফালাফালা করে দিতে পারে।
এ রকম বদ্ধ জায়গায় সবচেয়ে মারাত্মক হলো চিতাবাঘ।
ভাবনাটা অবশ করে দিতে চাইল তার শরীর।
পিছিয়ে যাবে?
লাভ নেই। যত তাড়াতাড়িই পিছাক, তারচেয়ে অনেক দ্রুত ছুটে আসতে পারবে চিতাবাঘ। ধরে ফেলতে কয়েক সেকেন্ডও লাগবে না।
ভয় পেয়েছে সে এটা বুঝতে পারলে আরও সাহস হয়ে যাবে বাঘটার। দ্বিধা থাকবে না আর, আক্রমণ করতে ছুটে আসবে।
মনে পড়ল কিশোরের কথা-ঘোৎ-ঘোৎ করবে…
কিন্তু শুয়োর হওয়ার ইচ্ছে নেই তার। জানোয়ারই যখন হতে হবে, চিতাবাঘই হবে, গর্জন করবে।
এমন গর্জন শুরু করল, দুনিয়ার কোন চিতাবাঘই তা পারবে না। একই সঙ্গে সামনের দিকে ছুটে গেল আক্রমণের ভঙ্গিতে। জানোয়ারটা সাহস সঞ্চয় করার আগেই তাকে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে হবে।
গর্জনের জবাবে গর্জন। জবাবটাও কম ভয়ঙ্কর নয়।
আরও জোরে গর্জন করতে লাগল মুসা। মনে হচ্ছে ফুসফুস ফেটে যাবে। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে জন্তুর মত করে যতটা জোরে সম্ভব ছুটে গেল সামনের দিকে।
ঠাস করে মাথায় মাথায় বাড়ি লাগল।
উফ! করে উঠল চিতাবাঘটা।
উফ! করে উঠল সে নিজেও।
বসে পড়ল দুই চিতাবাঘ। হাসতে লাগল। ভীতুর হাসি। কারণ দু-জনেই ভয় পেয়েছে সাংঘাতিক।
এখানে তোমার দেখা পাব, কল্পনাই করিনি, কিশোর বলল।
মুখটার কাছে অপেক্ষা করনি কেন? দু-ভাগে ভাগ হয়েছে যেখানটায়।
দু-ভাগ? বুঝতেই পারিনি! এখন বলো দেখি, ভুল পথে এলে কি করে?
আন্দাজে ঢুকে পড়েছি দুই সুড়ঙ্গের একটাতে।
ঘুরতে পারবে?
চেষ্টা করল মুসা। শরীর বাঁকিয়ে, মুচড়ে-টুচড়ে, অনেক ভাবে। শেষে বাদ দিল চেষ্টা।
পারব না। বেশি সরু।
তাহলে পিছাতেই হবে তোমাকে, উপায় নেই। বেশি দূর যেতে হবে না, ভেবো না, এই পাঁচ থেকে দশ মাইল! তিক্ত কণ্ঠে বলল কিশোর।
কি যেন ভাবল মুসা। শান্তকণ্ঠে বলল, দাঁড়াও, পাঁচ মিনিটেই ঘুরে যাব।
কি করে?
হাসল মুসা, জাদু জানি আমি। এসো।
পিছাতে লাগল মুসা। চলে এল দ্বিতীয় দুই-সুড়ঙ্গটার মুখে। পাশেরটাতে ঢুকে চুপ করে বসে রইল। তার পাশ কাটিয়ে গেল কিশোর। তখন পিছু নিল সে।
কিশোর ভাবল, এখনও তার সামনেই রয়েছে মুসা। হঠাৎ পেছনে এক ভয়াবহ গর্জন শুনে চমকে উঠল। অপেক্ষা করছে চিতাবাঘের ধারাল নখের আঁচড়ের। তার বদলে খোঁচা লাগল ছুরির মাথার।
তুমি! পেছনে গেলে কি করে!
বললাম না, জাদু।
আরে বাবা অত মশকরা করছ কেন? বলেই ফেলো না।
ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল মুসা।
একটা ঘণ্টা হামাগুড়ি দিল ওরা।
তারপর থেমে গেল কিশোর। আমার হাতও শেষ, হাঁটুও শেষ। আর কোন দিন উঠে দাঁড়াতে পারব না! জানোয়ার হয়ে বাঁচতে হবে।
চিত হয়ে শুয়ে পড়ল মুসা। না ঘুমিয়ে আর পারব না আমি। যাও, ঘুরে এসো। আমি এখানেই অপেক্ষা করব।