যতটা কষ্ট করে ঢুকেছে, ঠিক ততটাই কষ্ট করে শ্যাওলা যেখান থেকে শুরু হয়েছে সেখানে আবার বেরিয়ে এল ওরা। শ্যাওলার কিনারা ধরে এগোল। খুঁজে বের করল সুড়ঙ্গমুখটা। কিন্তু বড় বেশি সরু ওটা-সাপ কিংবা ইঁদুর-ঘঁচো জাতীয় প্রাণীরা তৈরি করেছে। কিন্তু চন্দ্ৰপাহাড়ের ইঁদুর-ঘঁচোও বেড়ালের চেয়ে বড়।
মুসা বলল, মোড়ামুড়ি করে ঢুকে যাওয়া যায়।
তা যায়। গিয়ে সাপের কামড় খেয়ে মারাও যায়। ইঁদুর চলাচল করলে এখানে সাপ থাকতে বাধ্য। মাম্বা কিংবা গোখরোর মুখোমুখি পড়লে আর বাঁচতে হবে না। অন্য কিছু করা দরকার।
কি করবে ভাবছে ওরা, এই সময় সমস্যার সমাধান করে দিল একটা শুয়োর। ছুটে বেরোল আরেকটা বড় সুড়ঙ্গমুখ দিয়ে। এতক্ষণ ওই মুখটা চোখে পড়েনি ওদের।
মানুষ দেখে থমকে দাঁড়াল শুয়োরটা। ঘেঁৎ-ঘোৎ শুরু করল। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে গোলমাল না করে ছাড়বে না।
ছুরির মত ধারাল ভয়ঙ্কর দাঁতগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। মুসাকে সাবধান করল, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো!
চোখ গরম করে গোঁ-গোঁ করে ধমক দিল শুয়োরটা, কয়েকবার আক্রমণ করার মিথ্যে হুমকি দিল। কিন্তু বোকা মানুষগুলো তার আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না দেখে বোধহয় ভাবল, এই কাপুরুষদের সঙ্গে লড়াই করে মজা নেই। শেষবারের মত একবার শাসিয়ে, দাঁত নাচিয়ে, নেমে চলে গেল পর্বতের ঢাল বেয়ে।
.
১০.
সুড়ঙ্গটার ভেতরে উঁকি দিল ওরা। তিন ফুট উঁচু, দুই ফুট মত চওড়া। ঘুটঘুটে অন্ধকার।
ভেতরটা মোটেও পছন্দ হলো না মুসার। হাত-পায়ে ভর দিয়ে এগোতে হবে। ভেতরে ঢুকে আরেকটা শুয়োরের যদি মুখোমুখি হয়ে যাই? যা অন্ধকারের অন্ধকার, বাপরে বাপ! সাংঘাতিক বিপদে পড়ব!
অন্য ভাবেও ভেবে দেখতে পারো। তোমার যেমন অপছন্দ, শুয়োরেরও তেমনি অপছন্দ হতে পারে এই সুড়ঙ্গ। চিতাবাঘের ভয়ে। সুতরাং সামনে যদি শুয়োর পড়ে, ঘোৎ-ঘোৎ করেই, তুমিও চেঁচানো শুরু করবে। চিতাবাঘের মত গর্জন করতে পারলে তো আরও ভাল। চিতাবাঘ সাজার এই মোক্ষম সুযোগ ছাড়া বোধহয় উচিত হবে না। কি বলো?
পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ। কিন্তু গর্জনের ওপর ভরসা করতে পারব না আমি। ছুরিটা হাতে রাখব। চিৎকার শুনে.ভয় না পেলে শেষ ভরসা এই ছুরি।
হাতে নয়, দাতে, শুধরে দিল কিশোর। হামাগুড়ি দেয়ার জন্যে হাত দুটো ব্যবহার করতে হবে তোমাকে। ছুরি ধরতে পারবে না।
চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে, দাঁতে ছুরি কামড়ে ধরার পর শুয়োরের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর মনে হলো না দুই গোয়েন্দাকে।
আগে সুড়ঙ্গে ঢুকল কিশোর। সামনে কোনও বিপদ থাকলে প্রথমে সে-ই সেটার মোকাবেলা করতে চায়।
এতে মুসা যে বিপদমুক্ত থাকল তা নয়, কারণ আক্রমণ পেছন থেকেও আসতে পারে।
তাতে বরং বিপদটা বেশিই, পেছন দিকে ছুরি চালাতে পারবে না। এত সরু সুড়ঙ্গে ঘোরার উপায় নেই।
বন্ধুকে সামনে থাকতে দেয়ায় শুরুতে যে অস্বস্তিটা ছিল, এখন আর নেই। বিপদে পড়লে কিশোর তো অন্তত ছুরি চালাতে পারবে, সে তা-ও পারবে না। তার সামনের দিকটায় একটা বাধা অন্তত আছে, পেছনে কিছুই নেই। একেবারে খোলা। শুয়োর এসে যদি দাঁত দিয়ে চিরে দেয়, কিংবা চিতাবাঘে কামড়ে ধরে, কিছুই করার থাকবে না তার।
চলো, এগোই, কিলোর বলল। কোন অসুবিধে আছে?
না, মানা করে দিল মুসা। বিপদটা বুঝতে যখন পারেনি তার বন্ধু, না বুঝুক, না বুঝে স্বস্তিতে থাকুক।
চলতে চলতে নতুন আরেকটা দুশ্চিন্তা এসে ভর করল মাথায়-কত লম্বা এই সুডঙ্গ কয়েক মাইলও হতে পারে। এভাবে হামা দিয়ে কতটা এগোনো সম্ভব? বিপদ আরও আছে। মাটিতে পড়ে থাকা কুটো আর চোখা পাথর ইতিমধ্যেই হাতের তালু আর হাটুতে খোঁচা দিতে আরম্ভ করেছে। এই অত্যাচার কতক্ষণ সইতে পারবে?
সামনে থেকে ডাকল কিশোর, মুসা, আসছ?
অনেকটা এগিয়ে গেছে সে। শ্যাওলার সুড়ঙ্গের ভেতর প্রতিধ্বনি তেমন হলো না, শব্দটাও কেমন চাপা চাপা।
চিৎকার করে জবাব দিল মুসা।
কয়েক মিনিট নীরবে হামাগুড়ি দিল সে। হঠাৎ শ্যাওলায় বাড়ি খেল মাথা। থেমে গিয়ে হাতড়ে হাতড়ে বোঝার চেষ্টা করল, ব্যাপারটা কি? দু-ভাগ হয়ে গেছে সুড়ঙ্গ।
এবার কি? কোনটা ধরে যাবে? ডাকল, কিশোর?
মনে হলো, তার মুখ ভর্তি তুলল। বিস্ময়কর ভাবে শব্দ চেপে দিচ্ছে শ্যাওলা। আবার চিৎকার করে ডাকল সে। কোন ফল হলো না। বেশিদূর এগোল না তার ডাক। সাড়াও মিলল না।
আবার চিৎকার করল।
জবাব নেই।
তার জন্যে অপেক্ষা করল না কেন কিশোর? হয়তো দু-ভাগ যে হয়ে গেছে সুড়ঙ্গ, এটা খেয়ালই করেনি। ভোলা পেয়েছে, ঢুকে পড়েছে। মাথায় বাড়ি না। লাগলে সে নিজেও বুঝতে পারত না। যেটা ভোলা পেত, সেটা দিয়েই ঢুকে যেত।
মাথা গরম হতে দিল না সে। তাতে বিপদ বাড়বে। শান্ত থেকে ভাবার চেষ্টা করল-কি ঘটতে পারে? সুড়ঙ্গটা যে ভাগ হয়েছে কিশোর এটা খেয়াল না করলে যেটা সোজা গেছে সেটা দিয়েই ঢুকবে। মোড় নিয়েছে যেটা সেটা দিয়ে নয়। তাহলে সোজা গেছে কোনটা? কি ভাবে বোঝা যাবে?
গাঢ় অন্ধকারে সেটা বোঝা কঠিন।
দুটো সুড়ঙ্গই সোজা গেছে মনে হচ্ছে।
ভীষণ লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। নিজেকে বোঝানোনার চেষ্টা করল-ভয়ে নয়, আসলে পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছি আমি। পরিশ্রম হবেই, রয়েছে খাড়া পর্বতের ঢালে। হাত-পায়ে ভর দিয়ে ঢাল বেয়ে ওপরের দিকে ওঠা সহজ ব্যাপার নয়।