লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। খাঁচার দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল।
চেপে ধরল তাকে বাচ্চাটা। চাপ দিতে শুরু করল। আরেকটু বাড়লেই মড়মড় করে পাঁজর ভেঙে যাবে মুসার। বুঝল, কিশোর ঠিকই বলেছে। ঢোকাটা উচিত হয়নি।
শুড়টা ধরার জন্যে হাতড়াতে শুরু করল সে। ওটাতে হাত বুলিয়ে দিতে পারলে হয়তো শান্ত করা যাবে।
একটা কান ঠেকল হাতে। একটা দাঁত। হাত চলে গেল যেখানে ঔড় থাকার কথা, কিন্তু নেই ওটা। তার বদলে চটচটে আঠাল পদার্থ ভিজিয়ে দিল হাত।
আরেকটু ওপর দিকে হাত তুলতে হাতে ঠেকল কাটা মাংস। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। আরও ওপরে কাটা ওঁড়ের গোড়াটুকু।
ব্যাপারটা বুঝে ফেলল মুসা। চুরি করতে এসে দু-জন প্রহরীকে খুন করেছে ডাকাতেরা। হাতিটাকে চুরি করতে চেয়েছে। কিন্তু তালা খুলতে পারেনি। বাচ্চাটা ভেবেছিল, কোন বন্ধু এসেছে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। শুড় বাড়িয়ে স্বাগত জানাতে গিয়েছিল সে। কেটে ফেলেছে ভয়ানক নিষ্ঠুর লোকটা। নিশ্চয় ভেবেছে-নিতেই যখন পারলাম না, অন্য কাউকেও রাখতে দেব না। শুড় কাটা হাতির কোন দাম নেই।
প্রচণ্ড যন্ত্রণায় পাগল হয়ে গেছে বাচ্চাটা। শান্ত করার আশা বৃথা। খাঁচায় থাকলে মরতে হবে। তাড়াতাড়ি দরজার দিকে এগোল কিশোর।
এই খেপা অবস্থায় শুড় থাকলে কিছুতেই বেরোতে পারত না মুসা, ধরে ফেলত তাকে হাতি। এখন ধরতে পারল না বটে, মাথা দিয়ে ঢুস মারতে ছাড়ল না।
খাঁচার বাইরে কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়ল মুসা।
তাড়াতাড়ি এসে তাকে তুলে নিল কয়েকজন কুলি।
খাঁচা থেকে ছুটে বেরোল ক্ষিপ্ত হাতি। যাকে সামনে পেল তাকেই ধরার চেষ্টা করতে লাগল। এদিক ওদিক ছুটে পালাতে শুরু করল লোকে।
কাউকে ধরতে না পেরে গায়ের দিকে ছুটল মত্ত হাতি। প্যাপিরাসের তৈরি কুঁড়ের বেড়াগুলো ধসিয়ে দিতে লাগল টুস মেরে। তছনছ করে ফেলতে লাগল সবকিছু।
আচমকা কানফাটা শব্দে গর্জে উঠল ভারি রাইফেল।
ঢলে পড়ল হাতিটা।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে তখন। সেই আবছা আলোয় কিশোরের হাতে রাইফেলটা দেখতে পেল মুসা।
কেন মারলে? চিৎকার করে উঠল সে।
আর কি করতে পারতাম!
কয়েক মিনিট সময় পেলে শান্ত করতে পারতাম ওকে। মেরে ফেলার দরকার ছিল না।
পারতে না। ওর গুঁড়ের যন্ত্রণা কমত না। ক্রমেই আরও ক্ষিপ্ত হত। রক্তক্ষরণে মরার আগে আরও কি কি ক্ষতি করত কে জানে। মানুষ মারলেও অবাক হতাম না।
কিন্তু ওষুধ আছে আমাদের কাছে। ওর চিকিৎসা করতে পারতাম।
দেখো মুসা, মাঝে মাঝে তুমি খুব বোকা হয়ে যাও! তোমার দুঃখ বুঝতে পারছি। একটা কথা বুঝতে পারছ না, জখমটা সারানো গেলেও কোনদিনই আর শুড় ফিরে পেত না সে। বেঁচে থাকতে সাংঘাতিক অসুবিধে হত। তোমার দুটো হাত কেটে দিলে কি অবস্থা হবে বলো? হাতির ঔড় না থাকলে আমাদের হাত না থাকার চেয়েও বেশি অসুবিধে হয়। পানিও খেতে পারে না। ওকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়ার আর কোন উপায় ছিল না।
ছুরি আর কুড়াল নিয়ে মৃতদেহটার ওপর ততক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়েছে গ্রামবাসীরা। হাতির মাংস তাদের প্রিয় খাবার। নষ্ট করার মানে হয় না।
কিশোরের কথায় তখনকার মত চুপ হয়ে গেলেও রাগ চাপা আগুনের মত ধিকিধিকি জ্বলতে লাগল মুসার মনে। ডাকাতদের ওপর বিষিয়ে গেছে মন। দাঁতে দাঁত চেপে কঠিন একটা প্রতিজ্ঞা করল সে। তাকাল বন্ধুর দিকে।
বুঝতে পারল কিশোর। নীরবে মাথা ঝাঁকাল শুধু।
.
০৯.
নাস্তার পর ঘটনাটা নিয়ে আকামির সঙ্গে আলোচনায় বসল কিশোর।
সামান্য কটা টাকার জন্যে এত নিষ্ঠুর হতে পারে কেউ, ভাবা যায় না! বলল সে। কাল রাতে আবার নিশ্চয় পায়ের ছাপ রেখে গেছে। কি মনে হয় তোমার, পিছু নিয়ে ধরা যাবে?
মাথা নাড়ল আকামি। না, লাভ নেই। কালকের অবস্থাই হবে। পানির কাছে টেনে নিয়ে যাবে আমাদের, তারপর ফুস!
যদি খালি জানতাম কোথায় থাকে ব্যাটারা! এতবড় পার্বত্য এলাকায় কোথায় খুঁজব ওদের?
হাঁটাচলাও সহজ নয় এখানে, মুসা বলল। রাস্তা তো নেইই, দুনিয়ার যত কাদা,হদ, জঙ্গল, খাড়া খাড়া টিলা আর তুষার।
তারপরেও, হাল আমরা ছেড়ে দিতে পারি না, কিশোর বলল। আকামি, সবাইকে বলো তৈরি হতে। একঘণ্টার মধ্যেই বেরোব আমরা।
হঠাৎ একটা শব্দ শুনে ফিরে তাকাল মুসা। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল। বন থেকে বেরোতে দেখেছে খুদে দানবকে।
মাথা বের করেই দাঁড়িয়ে গেছে হাতির বাচ্চাটা। সাবধানে তাকাচ্ছে। মুসাকে দেখে চিৎকার করে উঠল আনন্দে। ছুটে এল তার দিকে।
মুসাও ছুটে গেল। কোথায় ছিলি তুই খুদে! জলদি বল! কেমন আছিস?
ম্যাজিকের মত চারপাশে লোক জড় হয়ে গেল। মুসার দুঃখ দেখে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল ওদেরও, আনন্দ দেখে খুশি হলো।
সবাই খুশি, কেবল সর্দার ওগারো বাদে।
আমার ছেলে? আমার ছেলে তো এল না ওর সঙ্গে।
সবগুলো চোখ ঘুরে গেল বনের দিকে। আউরোকে দেখা গেল না। ডাকাতদের আখড়া থেকে পালিয়ে এসেছে একলা খুদে দানব। কাদায় মাখামাখি। তাকে হ্রদে গোসল করাতে নিয়ে গেল মুসা।
ভাল করে গোসল করিয়ে তাকে নিয়ে পানি থেকে উঠে এল সে। খেতে দিল।
অনেক অত্যাচার চলেছে বেচারার ওপর। চামড়ায় আঁচড় আর কাটাকুটির দাগ। কাটা বসানো ভারি বুটের লাথি আর চামড়ার চাবুকের বাড়ির স্বাক্ষর ওগুলো।
ভীষণ রাগ লাগছে মুসার। শাস্তি দিতেই হবে শয়তানগুলোকে। আউরোকেও উদ্ধার করে আনতে হবে। কিন্তু ওদের আস্তানাটা খুঁজে পাবে কি করে? পায়ের ছাপ ধরে গিয়ে যে লাভ নেই, সে তো জানাই হয়ে গেছে।