বড় মায়া লাগল মুসার। কিন্তু কি করবে? বিশাল একটা হাতিকে কাদা থেকে তুলে আনার সাধ্য তাদের নেই।
এই করুণ দৃশ্য মন খারাপ করে দিল অভিযাত্রীদের। কাদার ভয়াবহতাও বুঝতে পারল। এই কাদা মাড়িয়ে আর এগোনোর সাহস করল না।
তা ছাড়া পায়ের ছাপ নেই, কোন চিহ্ন নেই, কোন দিকে এগোবে? অহেতুক আর হাঁটাহাঁটি না করে নিরাশ হয়ে গায়ে ফিরে চলল দলটা।
অদ্ভুত একটা কাণ্ড করল এই সময় হাতির বাচ্চাটা। একাকী এই ভয়ঙ্কর জায়গায় থাকতে যেন সাহস হলো না তার, মানুষের পিছে পিছে চলল।
হাতির বাচ্চারা এ রকম করে, জানা আছে মুসার। নিরালা জায়গায় একলা থাকতে ভয় পায়। কি মনে হতে হাত বাড়িয়ে ডাকল ওটাকে সে। কুকুরের বাচ্চার মতই সাড়া দিল হাতির বাচ্চা। এগিয়ে এসে তার হাতে ঔড় ঘষতে লাগল।
আদর করে তার শুড়ে হাত ঘষে দিল মুসা। সহজেই জন্তু-জানোয়ার নেওটা হয়ে যায় তার। এই বাচ্চাটারও হতে দেরি লাগল না। নামও একটা দিয়ে দেয়া হলো। মায়ের কাদায় ডুবে মরার ঘটনাটা স্মরণীয় করে রাখার জন্যে বাচ্চার নামকরণ হলো কাদার খোকা।
.
০৮.
অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিল সর্দার ওগারো, ওদের দেখেই দৌড়ে এল। ভেজা চুপচুপে, কাদামাখা বিধ্বস্ত মানুষগুলোকে দেখেই অনুমান করে নিল কি ঘটেছে। তবু জিজ্ঞেস করল, আমার ছেলেকে পেয়েছ?
নীরবে মাথা নাড়ল কিশোর।
বিষণ্ণ চোখ তুলে পর্বতের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল সর্দার, হে বজ্ৰমানব, তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে মানুষের কিছু করার নেই! বুঝলাম, আর কোনদিন ছেলেকে দেখতে পাব না আমি!
দেখুন, এত সহজে হাল ছাড়বেন না, বোঝাতে চাইল কিশোর, আমরা এখনও চেষ্টা ছাড়িনি। খবরটা পুলিশকে জানিয়েছেন?
লোক পাঠিয়েছি। কিন্তু জানি, লাভ হবে না। এমনিতেই অনেক কাজ পুলিশের, গোলমাল লেগেই আছে দেশে, ছেলে হারানোর মত একটা ছোট্ট ঘটনাকে পাত্তাই দেবে না ওরা। আসবে না।
বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে কুঁড়েতে ফিরে গেল সর্দার।
শরীর থেকে আঠাল কাদা ধুয়ে ফেলার জন্যে হ্রদে নামল কিশোর-মুসা আর তাদের সঙ্গীরা।
প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। ক্যাম্পে যারা ছিল, তারা রান্না করেই রেখেছে। তাঁবুতে ঢুকেই খেতে বসে গেল কিশোররা। গপগপ করে গিলতে লাগল সবাই। কাদার খোকারও খাবারের ব্যবস্থা করল কুলিরা।
পেট শান্ত হয়ে এলে মুসা জিজ্ঞেস করল, আজ রাতে কি করব? পাহারা লাগবে? হাতির এই বাচ্চাটাকেও যদি চুরি করতে আসে?
খাঁচায় তালা দিয়ে রাখব, জবাব দিল কিশোর।
খাঁচায় ঢুকতে চাইল না হাতির বাচ্চা। শেষে মুসাকে আগে ঢুকে গিয়ে ডেকে ডেকে তাকে ঢোকাতে হলো। তারপর এক ফাঁকে পিছলে বেরিয়ে চলে এল সে। চট করে তখন দরজা লাগিয়ে তালা আটকে দেয়া হলো। শিকের ফাঁক দিয়ে শুড় বের করে হাতির ভাষায় প্রতিবাদ জানাতে লাগল কাদার খোকা। আদর করে তার ওঁড়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল মুসা, থাক, কোন ভয় নেই। এখানে তুই বেশি নিরাপদ।
বলল বটে, কেন যেন কথাটা নিজেই বিশ্বাস করতে পারল না। আগের রাতে খুদে দানবকেও এ রকম অভয় দিয়েছিল। কিন্তু রক্ষা করতে পারল কই?
তবে এদিন আর ভুল করল না। এক তালার ওপর ভারি আরেকটা তালা লাগাল সে। দেখি, এবার কি করে খোলে ব্যাটারা?
ঝুঁকি নিতে চাইল না কিশোর, পাহারার ব্যবস্থা করল। হাতির বাচ্চাটা ছাড়াও আরও অনেক দামী দামী জানোয়ার আছে। নিলে ভাল দামে বেচতে পারবে ডাকাতরা।
আকামি আর মুংগা বেজায় ক্লান্ত। কুলিদের কারও ওপর পাহারার ভার দিতে ভরসা পেল না কিশোর। সর্দার ওগারোর সঙ্গে পরামর্শ করল।
গ্রাম থেকে লোক দিল সর্দার।
হাতে বল্লম নিয়ে খাঁচার সামনে পাহারায় বসল দুজন শক্তিশালী উয়াটুসি যোদ্ধা।
.
আহত হাতির চিৎকারের মত অদ্ভুত শব্দ পৃথিবীতে আর আছে বলে জানা নেই মুসার। চমকে জেগে গেল সে। মেরুদণ্ডে বয়ে গেল শীতল শিহরণ, শিরশির করে উঠল চামড়া, খাড়া হয়ে গেল রোম। মনে হলো বিদ্যুতের তার ছুঁয়ে ফেলেছে।
একটা মুহূর্ত যেন পাথর হয়ে পড়ে রইল সে। তারপর বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড় দিল তাবুর বাইরে, কি হয়েছে দেখার জন্যে।
খাঁচার কাছে এসে হোঁচট খেল। কিসে লাগল দেখার জন্যে তাকাল নিচে। অন্ধকার এখনও কাটেনি। আবছা ভাবে দেখল ওগারোর একজন প্রহরী পড়ে আছে। নিথর। তাড়াতাড়ি বসে তার নাড়ি দেখল। মারা গেছে লোকটা।
হাতড়ে হাতড়ে দ্বিতীয় লোকটাকেও বের করল সে। সে-ও মৃত।
পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কিশোর। তাঁবু থেকে বেরোতে শুরু করেছে কুলিরা। গা থেকে আসছে গ্রামবাসীরা। খাঁচার মধ্যে এখনও চিৎকার করে চলেছে হাতির বাচ্চাটা।
কি হয়েছে ওর? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর।
মনে হয় ডাকাতেরা ভয় দেখিয়েছে।
তালায় হাত দিয়ে দেখল মুসা। একটা ভোলা। আরেকটা লাগানো রয়েছে।
দৌড়ে তাবুতে গিয়ে চাবি নিয়ে এল সে। তালা খুলল।
কি করবে?
ভেতরে গিয়ে ওকে শান্ত করব।
যেয়ো না! এখনওর হুঁশ নেই, খুন করে ফেলবে!
করবে না। আমাকে চেনে।
দরজা খুলে আস্তে ঢুকে পড়ল মুসা।
এই, খোকা, চুপ কর! আমি, চিনতে পারছিস না? আমি…
কিন্তু তার কথা হাতির কানে ঢুকল বলে মনে হলো না। নিজের চিৎকারেই হয়তো কান ঝালাপালা, মুসার কথা আর শুনতে পাচ্ছে না। এক ধাক্কায় তাকে ফেলে দিল।