কিন্তু দমল না ওরা। হাতির পায়ের ছাপ অনুসরণ করে ঠিকই এগিয়ে চলল।
খুদে দানবের ছাপের পাশে মাঝেসাঝে খালি পায়ের ছোট ছাপ চোখে পড়ছে, বোধহয় সর্দারের ছেলে আউরোরই হবে।
বেচারা আউরো! আনমনে বলল কিশোর, যা শুনলাম, সুন্দর চেহারার ছেলেমেয়েগুলোকেই কেবল নিয়ে যায়। কেন নেয়?
আন্দাজ করতে পারি, আকামি বলল।
কেন?
কিডন্যাপাররা স্ন্যাভার, মানুষের ব্যবসা করে। গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয়। সুন্দর চেহারাগুলো নেয় বেশি দাম পাবে বলে।
কান খাড়া করে ফেলেছে মুসা। কিন্তু দাস ব্যবসা তো বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে বলে শুনেছি? এর বিরুদ্ধে এখন কড়া আইন করা হয়েছে।
কই আর হলো? আকামির হয়ে জবাব দিল কিশোর। আগের মত খোলাখুলি বাজারে বিক্রি হয় না, এই যা। গোপনে গোপনে এখনও হরদম চলছে এই ব্যবসা। শুধু আফ্রিকাই নয়, ভারত, বাংলাদেশ আর ওরকম দরিদ্র আরও অনেক দেশ থেকে মানুষ পাচার করে দেয়া হয় ধনী দেশগুলোতে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে। নারী আর শিশুরাই প্রধানত এসবের শিকার।
নিশ্চয় জাহাজে করে সাগর পার করে নিয়ে যায়। সেজন্যেই জাহাজীদের গায়ের গন্ধ পেয়েছে আকামি।
মাথা ঝাঁকাল আকামি।
সামনে পেলে গন্ধ শুঁকে চিনতে পারবে লোকটাকে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
নিশ্চয় পারব। আরবদের ওই ডাউ জাহাজগুলোর গন্ধ বড় বদ। একবার নাকে ঢুকলে জীবনে আর ভোলার উপায় নেই।
হ্রদের পাড়ে এসে দাঁড়াল ওরা। সব চিহ্ন আচমকা শেষ হয়ে গেছে এখান থেকে। আকামির মত ওস্তাদ ট্র্যাকারও আর কোন চিহ্ন খুঁজে পাচ্ছে না।
ব্যাটারা ভীষণ চালাক, বলল সে। এখান থেকে কোথায় গেছে বলার উপায় নেই। পানিতে নেমেছে এটুকু বুঝতে পারছি। কিন্তু তারপর? যে কোনও দিক দিয়ে নেমে অল্প পানিতে হেঁটে গিয়ে আবার পাড়ে উঠতে পারে। সাঁতরে লেক পার হয়েও ওপাড়ে চলে যেতে পারে। কোনটা করেছে?
হাতি কি সাঁতরাতে পারে নাকি? জানতে চাইল মুসা।
খুব ভাল পারে, জবাব দিল তার বন্ধু। তবে পানি বেশি গভীর না হলে সাঁতরানোর চেয়ে তলা দিয়ে হেঁটে চলে যেতেই বেশি পছন্দ করে ওরা।
তাজ্জব ব্যাপার! শ্বাস নেয় কি করে?
শুড়টা উঁচু করে রাখে, নাকের ফুটো বের করে রাখে পানির ওপর।
তাহলে তো পানির নিচে কাদায় পায়ের ছাপ থাকার কথা।
হ্রদটা বেশি গভীর না। টলটলে পরিষ্কার পানিতে চোখ ডুবিয়ে নিচের কাদা দেখতে লাগল আকামি। কিছুই দেখতে পেল না। একটা পরীক্ষা করল তখন। নেমে গেল পানিতে। পা দেবে গেল কাদায়। নাড়া লেগে ঘোলা হয়ে গেল পানি। ওপরে উঠে এল সে। আবার পানিতে চোখ ডুবিয়ে দেখল। আস্তে আস্তে থিতিয়ে গেল কাদা, আবার পরিষ্কার হলো পানি। তার পায়ের ছাপ নেই।
তারমানে হাতি এদিক দিয়ে গেলেও বোঝার উপায় নেই, চারপাশ থেকে গলিত কাদা সরে এসে নিমেষে ঢেকে দিয়েছে তার পায়ের ছাপ।
কোনওখান দিয়ে তো নিশ্চয় উঠেছে পানি থেকে, মুসা বলল। পাড়ে নিশ্চয় ছাপ পড়েছে। সেটা খুঁজে বের করলেই তো পারি?
কিন্তু বিশেষ আশাবাদী হতে পারল না আকামি। কারণ অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। পায়ের ছাপ পড়লে সেটা মুছে দেবে এই বৃষ্টি। তবু কিশোরের কথার প্রতিবাদ না করে হ্রদের পাড়ে খুঁজতে শুরু করল সে।
সাংঘাতিক বিরক্তিকর এই শীতল বৃষ্টি। বেশিক্ষণ এর মধ্যে থাকলে একধরনের অস্থিরতায় পেয়ে বসে মানুষকে। কুলিদের মধ্যে সেই লক্ষণ দেখা যেতে শুরু করল।
হ্রদের পশ্চিম পাড়ে এসে আরেক বিপদ, চলাই মুশকিল হয়ে উঠল। থিকথিকে কালো কাদা, পা পড়লে ডেবে যায়-কোথাও কোথাও হাঁটু পর্যন্ত দাবে। কি মনে হতে ম্যাপ বের করল কিশোর। দেখল, এখানেই আছে সেই কুখ্যাত বিগো বগ, এর ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রচুর লেখালেখি করেছে অভিযাত্রীরা। পানি আর কাদার আঠাল সূপ তৈরি হয়ে থাকে যেন এখানে। মানুষের পা আঁকড়ে ধরে রাখে। এর মধ্যে হাঁটতে গেলে সাংঘাতিক পরিশ্রম।
শরীর ডেবে গেলেও এটাকে চোরাকাদা বলা যাবে না। কারণ চোরাকাদাকে যেমন অতল বলা হয়, এটা ঠিক সেরকম নয়। তবে চোরাকাদার চেয়ে কম বিপজ্জনকও নয়। যেখানে বেশি গভীর, সেখানে পড়লে অন্যের সাহায্য ছাড়া উঠে আসা কঠিন।
কাদার মধ্যে নেমে এগোনোর চেষ্টা করতে হঠাৎ কোমর পর্যন্ত ডেবে গেল আকামির। সবাই মিলে টেনেটুনে তাকে তুলে আনল বগ থেকে।
হেঁটে যেতে পারবে না বুঝে সাঁতরে যাওয়ার চেষ্টা করল মুসা। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার মত করে পড়ল তরল কাদার ওপর। মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল তার। শরীর।
তাড়াতাড়ি কাদার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে তার বাহু ধরে টেনে তুলে আনল কিশোর আর আকামি।
সারা গায়ে কাদা মেখে ভূত সেজে গেছে মুসা। হাত দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, বাপরে বাপ, কি জঘন্য! পানি আর কাদা যে এক জিনিস নয় এতদিনে বুঝলাম! সাঁতার কাটা অসম্ভব!
এই সময় একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল ওদের। দুটো হাতি। একটা বড় মাদী, আরেকটা ছোট মদ্দা-বয়েস খুব অল্প, সবে কৈশোর পেরিয়েছে। কিন্তু বাচ্চা হলেও হাতির বাচ্চা, গায়ে-গতরে অনেক বেড়ে গেছে। বড়টা সম্ভবত ছোটটার মা।
কাদায় পড়েছে বড়টা। পাড়ে দাঁড়িয়ে খুঁড়ে ড় লাগিয়ে তাকে টেনে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে বাচ্চাটা।
অনেক চেষ্টা করেও মাকে তুলতে পারল না সে। মায়ের তুলনায় অনেক ছোট, গায়ে শক্তিও কম, অতবড় ভারি একটা শরীরকে কি আর তুলে আনতে পারে? আর্তচিৎকার করতে করতে কাদায় পুরোপুরি ডুবে গেল মা। বিলাপ করে কাঁদতে শুরু করল বাচ্চাটা, কাদার পাড়ে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। অনেকটা মা হারা মানবশিশুর মতই।