কি করবে বুঝতে পারছে না আকামি আর মুংগা।
তবে খানিক পরে বোঝা গেল গরিলাটাই পরাজিত হতে চলেছে। কয়েক ইঞ্চি পিছিয়ে গেল ওটা। সঙ্গে সঙ্গে এক পা এগিয়ে গেল ছেলেরা। হাত নেড়ে এমন ভঙ্গি করছে যেন ধরতে পারলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবে গরিলাকে।
চিৎকার থামিয়ে দিল গরিলাটা। মুখের ভাব বদলে গেল। চোখে ভয় ফুটছে।
হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে, লম্বা দুই হাত মাটিতে নামিয়ে দিয়ে, কব্জিতে ভর রেখে, চার হাত-পায়ে হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেল ঝোঁপের ভেতর।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। ভয়টা প্রকাশ করল এতক্ষণে। বলল, আমার পা জমে গেছে।
হাসল কিলোর। তোমার কিছু খাবার দরকার। বাঁশের কোঁড় খেয়ে দেখতে পারো।
আরও! ভয়ে ভয়ে গাছের নিচে ছায়ার দিকে তাকাতে লাগল মুসা, এখন তার মনে হচ্ছে প্রতিটি ছায়াই একটা করে গরিলা। না খেয়ে মরে যাব, তবু বাঁশের কেড়ের লোভ আর করছি না!
আবার চলতে শুরু করল ওরা। বাঁশবন থেকে বেরিয়ে এল খোলা তৃণভূমিতে।
তারপরে একটা হ্রদ। বৃষ্টির মধ্যেও খুব সুন্দর লাগছে দেখতে।
বৃষ্টি-ভেজা আজব এই পার্বত্য অঞ্চলের এটা আরেক অদ্ভুত ব্যাপার। ঢালটা যেন বিচিত্র এক ব্যালকনি, আর প্রতিটি ব্যালকনিতে রয়েছে একটা করে হদ। অভিযাত্রীরা চমৎকার সব নাম দিয়েছে এগুলোর-গ্রীন লেক, ব্ল্যাক লেক, হোয়াইট লেক, গ্নে লেক। ওপর থেকে নেমে আসা বরফগলা পানি আর ক্রমাগত বষ্টির পানিতে সব সময় টুইটম্বুর থাকে হ্রদগুলো। প্রতিটি ব্যালকনি থেকে জলপ্রপাতের মত পানি ঝরে পড়ছে তার নিচের হ্রদটায়।
উদ্বিগ্ন হয়ে আকামি বলল, ওই পানিতে পায়ের ছাপ মুছে যাবে। এগোব কি করে?
হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল সে। বিশাল একটা ফুলের ওপর বসে রয়েছে চন্দ্ৰপাহাড়ের এক ভয়াল চেহারার প্রাণী। একটা ক্যামেলিয়ন। বড় বড় চোখ, মাথা থেকে বেরিয়েছে তিনটে শিং, যেন প্রাগৈতিহাসিক দানবের খুদে সংস্করণ।
খুব খারাপ লক্ষণ, আকামি বলল। কোনখানে যাওয়ার সময় এই প্রাণী সামনে পড়লে আর এগোনো উচিত না। এগোলেই বিপদ।
এ সব কুসংস্কার বিশ্বাস করে না কিশোর, অধৈর্য হয়ে বলল, হলে হবে। এগোও।
সঙ্গে আসা কুলিরাও দাঁড়িয়ে গেছে। কেউ এগোতে রাজি নয়। ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে ছোট্ট গিরগিটিটার দিকে। আকামির সঙ্গে ওরাও একমত-ক্যাম্পে ফিরে যাওয়া উচিত।
দেখো, বোঝনোর চেষ্টা করল কিশোর, তোমরা সবাই সাহসী মানুষ। ভয়ানক বাঘ-সিংহের মুখোমুখি হতে পরোয়া কোরো না। হাতি-গণ্ডারের সঙ্গে লাগতে ভয় পাও না। দাঁত নেই, বিষ নেই এমন একটা খুদে প্রাণীকে ভয় পাচ্ছ তোমাদের মত মানুষ, এ কথা বিশ্বাস করতে বলল আমাকে?
প্রাণীটার মুখের কাছে আঙুল নিয়ে গেল কিশোর।
আতঙ্কিত চোখে নীরবে তাকিয়ে রয়েছে লোকগুলো।
নড়ল না ক্যামেলিয়নটা। কোথা থেকে উড়ে এসে একটা মাছি বসল কিশোরের আঙুলে। ক্যামেলিয়নের মুখ থেকে বিদ্যুতের মত ছিটকে বেরিয়ে এল লিকলিকে জিভ, মাছিটাকে আটকে ধরে নিয়ে চলে গেল আবার মুখের ভেতর।
অনেকটা পিঁপড়েখেকোর মত কাজ করে এর জিভ, মুসাকে বলল কিশোর। কেমন লম্বা দেখলেই তো। চটচটে আঠা, লাগলে আর ছুটতে পারে না।
মাছিটাকে খেয়ে আরেকটা ফুলের ওপর সরে গেল ক্যামেলিয়নটা। এতক্ষণ ছিল নীল ফুলের ওপর, তার শরীরের রঙও ছিল নীল; যেই কমলা রঙের অন্য ফুলটাতে গেল, শরীরটা হয়ে গেল কমলা। মুহূর্তে গায়ের রঙ বদলে ফেলেছে।
দেখলেন! কাঁপা গলায় বলল আকামি, জাদু জানে!
জাদু না ছাই! রেগে গেল কিশোর। নিজেকে বাঁচানোর আর কোন উপায় নেই এটার, তাই এই ব্যবস্থা করে দিয়েছে প্রকৃতি। ভয়ঙ্কর চেহারা বানিয়েছে, যাতে অন্যেরা খেতে না আসে একে, ভয় পেয়ে সরে যায়। নিজের রঙ বদলাতে পারে, যাতে যে ফুলের ওপর বসবে তার সঙ্গে মিশে গিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে। দুটো কাজ হয় এতে-শত্রুর চোখ এড়িয়ে থাকতে পারে, শিকারও তাকে দেখতে পায় না বলে জিভের নাগালে চলে আসে।
কিন্তু কোনভাবেই বোঝানো গেল না কুসংস্কারাচ্ছন্ন কুলিদের।
রেগেমেগে শেষে কিশোর বলল, বেশ, তোমরা না আসতে চাইলে চলে যাও। আমি আর মুসা একাই যেতে পারব।
ক্যামেলিয়নটার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল সে। পেছনে চলল মুসা।
আধ মাইলও গিয়ে সারেনি, ছুটতে ছুটতে এল আকামি। জিজ্ঞেস করল, সত্যিই তাহলে ফিরে যাবেন না?
না, কিশোর বলল। তোমার আসার দরকার নেই।
আমি যাব আপনাদের সঙ্গে।
কিন্তু অশুভ লক্ষণ যে দেখলে?
বিপদে পড়লে একসঙ্গেই পড়ব। আপনাদের ফেলে আমি যাব না।
লোকটার বিশ্বস্ততায় গলে গেল কিশোর। কতটা দুঃসাহস দেখাচ্ছে আন্দাজ করতে পারল। রক্তে মিশে যাওয়া শত বছরের কুসংস্কার ভাঙতে চলেছে সে, সোজা কথা নয়।
কিন্তু আকামি একাই নয়, কয়েক মিনিট পর হাঁপাতে হাঁপাতে মুংগাও এসে হাজির।
অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল কিশোর।
হাতের রাইফেলটা দেখিয়ে কৈফিয়তের সুরে মুংগা বলল, ভাবলাম, এটা ফেলে যাচ্ছেন, বিপদে পড়তে পারেন। তাই নিয়ে এলাম।
নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল কিশোর।
সরে গেল মুংগা। না না, আপনার বয়ে নেয়া লাগবে না। আমিই নিতে পারব।
খানিক পর এক এক করে ফিরে এল সব কজন। একজন লোকও ক্যাম্পে ফিরে যায়নি। ক্যামেলিয়নের ভয় কাউকে ঠেকাতে পারল না শেষ পর্যন্ত।
.
০৭.
বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। অঝোরে ঝরছে এখন বড় বড় ফোঁটায়। মাথার ওপর অনেক নেমে এসেছে কালো মেঘ। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যায়। অন্ধকারও বেড়েছে। দশ ফুট দূরের জিনিসও আর চোখে পড়ে না ঠিকমত।