আমি তো জানতাম বাঁশ শুধু মানুষে খায়। চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলোতে পাওয়া যায় বাঁশের তরকারি।
উয়াটুসি আর পিগমিরাও পছন্দ করে। গরিলার তো খুব প্রিয় খাবার। দেখো, গরিলারা ঘুরে গেছে এখান থেকে।
ভেজা নরম মাটিতে স্পষ্ট দেখা গেল গরিলার পায়ের ছাপ। মানুষের খানি পায়ের ছাপের মতই দেখতে। তবে আকারে অনেক বড়, এর পাশে পূর্ণবয়স্ক মানুষের পায়ের ছাপকে মনে হবে শিশুর পায়ের মত।
এত গভীর কেন? জানতে চাইল মুসা।
হবে না, যা ভারির ভারি। একটা পূর্ণবয়স্ক পুরুষ গরিলার ওজন হয় সাতশো পাউন্ড, বড় একজন মানুষের চারগুণ।
গেল তো এখান দিয়েই, বাঁশের এই চারাটাকে খেলো না কেন?
এটা গজানোর আগেই হয়তো গেছে। যত দূরে চলে যায় ততই ভাল। রোমশ ওই ভদ্রলোকদের সঙ্গে মোলাকাত করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার।
কেন, ভয় পাচ্ছ?
না পাওয়ার কোন কারণ আছে? আদর করে যদি তোমার গায়ে হাত ছোঁয়ায়। তাহলেই চিত হয়ে যাবে। চারপাশে তাকাল কিশোর। আল্লাই জানে, কাছাকাছি আছে কিনা! দেখছে কিনা এখন আমাদের!
অত ভয় পাচ্ছ কেন? হামলা চালাবে নাকি?
গরিলার মেজাজ-মর্জির কোন ঠিক ঠিকানা নেই। চালাতেও পারে।
বিরক্ত না করলেও মারতে আসবে? কোন জানোয়ারই নাকি বিরক্ত না হলে মানুষকে আক্রমণ করে না?
তা করে না। কিন্তু কিসে যে গরিলাকে বিরক্ত করবে, সেটা বলাই মুশকিল।
এগিয়ে গেছে আকামি আর মুংগা। বাশের আড়ালে হারিয়ে গেছে। ওদেরকে ধরার জন্যে তাড়াতাড়ি এগোল দু-জনে।
বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশে কালো মেঘ। অন্ধকার কেমন নিঃসঙ্গ আর বিষণ্ণ করে তুলেছে বনতল। ভারি, এক ধরনের চাপা ঘড়ঘড় শব্দ ভেসে এল হঠাৎ। ঝট করে শব্দের দিকে ফিরে তাকাল দু-জনে।
গরিলার বাসা আছে এখানে! নিচু স্বরে বলল কিশোর।
কিন্তু বাসাটা পাওয়া গেলেও তার মধ্যে গরিলা দেখা গেল না। দুই ফুট উঁচু করে গাছের ডালপাতা আর ঘাস বিছিয়ে একটা গদিমত তৈরি করা হয়েছে। গরিলার বিছানা।
আমি তো জানতাম গাছে থাকে ওরা, মুসা বলল।
গাছে চড়তে পারে, তবে রাতে ডালে থাকতে চায় না। এত ভারি শরীরের ভারে ডাল ভেঙে পড়ার ভয়ে বেশি ওপরেও উঠতে চায় না। বড়গুলো তো মাটি ছেড়ে নড়েই না।
বিড়বিড়, ফিসফাস, ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে কথা বলছে যেন অনেক মানুষ। এগিয়ে আসছে কমে। কিসের শব্দ, আন্দাজ করতে পারছে না মুসা। তবে শব্দ নিয়ে মাথা ঘামানোর আগে পেট নিয়ে ঘামানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল সে। সামনে আবছা অন্ধকারে একটা বাঁশের কোঁড় গজিয়ে ঢাকতে দেখল। হাতের কাছে আর কোন খাবার নেই দেখে ছুরি বের করে নিয়ে এগোল কেটে নেয়ার জন্যে। ভাবল, গরিলারা যদি খেতে পারে, সে পারবে না কেন?
০৬.
বিষণ্ণ অন্ধকারকে যেন খানখান করে দিল তীব্র, তীক্ষ্ণ চিৎকার। শিরশির করে উঠল মুসার পিঠের কাছটায়। পাঁচ ফুট দূরের যে কালো ছায়াটাকে বনের ছায়া মনে করেছিল সে, আসলে ওটা একটা গরিলা। একজন উয়াটুসি পুরুষের সমান লম্বা, কিন্তু তিন-চারগুণ চওড়া। কুচকুচে কালো শরীর, তার মধ্যে সাদা বলতে কেবল বিকট হ থেকে বেরিয়ে থাকা ভয়ঙ্কর দাঁতগুলো। গভীর কোটরে বসা চোখের রঙও কালো। কালো নাকটাকে মনে হচ্ছে শক্ত রবারে তৈরি, আর দাড়িকে লাগছে রঙ করার ব্রাশের মত।
লম্বা একটা কালো হাত বাড়িয়ে মুসার হাত থেকে বাঁশের কোড়টা কেড়ে নিল গরিলা। ছুঁড়ে দিল ঝোঁপের ভেতর। কিচমিচ করে উঠল কয়েকটা কণ্ঠ। তারমানে। ওখানে রয়েছে তার বাচ্চাগুলো। দুই হাতে নিজের বুকে দমাদম কিল মেরে যেন ঢাক বাজাতে শুরু করল গরিলাটা। এতেও সন্তুষ্ট হতে না পেরে ঢাকের সঙ্গে সঙ্গত করার জন্যে গলা ছেড়ে চিৎকার করতে লাগল।
এই শিক্ষা জীবনে ভুলবে না মুসা। কোন বড় জানোয়ারকে বিরক্ত করার পর যে অভিজ্ঞতা হয় সেটা বলার জন্যে বেঁচে থাকে না বেশির ভাগ মানুষই। কেন যে কি কারণে বিরক্ত হবে জানোয়ারেরা, সেটাও ঠিক করে বলার উপায় নেই। এই যেমন, এই গরিলাটা হয়েছে মুসা একটা বাঁশের কোড় তুলেছে বলে।
দুপদাপ করে হৃৎপিণ্ডটা লাফাচ্ছে ওর। পিছাতে শুরু করল মুসা। অতবড় এক গরিলার সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইয়ে যাওয়ার মত বোকামি আর হয় না। সঙ্গে বন্দুক নেই। আছে শুধু দু-জনের কাছে দুটো ছুরি। এই দানবের বিরুদ্ধে সেগুলো দুটো সাধারণ শলাকা মাত্র।
পিছাতে পিছাতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরের গায়ের ওপর এসে পড়ল মুসা।
দাঁড়িয়ে থাকো, ফিসফিস করে বলল কিশোর। একচুল নড়বে না। যেই বুঝবে তুমি ভয় পেয়েছ, মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলবে মুণ্ডটা।
পাশাপাশি দাঁড়াল দু-জনে।
সমানে ঢাক বাজিয়ে চলেছে গরিলাটা। চিৎকারও বন্ধ করছে না। আট ইঞ্চি লম্বা হাতের রোম। থাবাটা যেন একটা ভাত খাওয়ার বাসন।
ওর ভাষাতেই ওকে শাসানো দরকার, কিশোর বলল।
নিজের বুকে চাপড় মারতে শুরু করল সে। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে এমন ভঙ্গি করে ফেলল, কুৎসিত ভঙ্গি, যেন সে-ও একটা গরিলা। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল।
দেখাদেখি মুসাও তা-ই করল।
দু-জন মানুষ আর একটা গরিলার মিলিত বিচিত্র চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল বাশবনে। চতুর্দিকে এখানে ওখানে শুরু হয়ে গেল আরও গরিলার ঢাক বাজানো আর চিৎকার। কলরব শুরু করল পাখি আর বানরের দল।
কি হয়েছে দেখার জন্যে দৌড়ে এল আকামি আর মুংগা। সঙ্গে কুলিরা। কাণ্ড দেখে তো হতবাক। একটা গরিলা চাইছে দুটো ছেলেকে ভয় দেখাতে, আর ছেলেরা চাইছে গরিলাটাকে ভয় দেখাতে।